হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)
উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশা সিদ্দীকা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা স্ত্রী। তাঁর ডাকনাম বা কুনিয়াত উম্মু ‘আবদিল্লাহ এবং উপাধি সিদ্দীকা। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তাঁর অন্য একটি উপাধি আল-হুমায়রা। তিনি ফরসা সুন্দরী ছিলেন। এ কারণে আল-হুমায়রা বলা হতো।
উরওয়া বলেনঃ একবার হিজাবের হুকুম নাযিলের পূর্বে উয়ায়না ইবন হিসন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তখন আয়িশা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উয়ায়না আয়িশার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ
ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ ‘আল-হুমায়রা’ (সুন্দরীটি) কে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দেনঃ এ হচ্ছে আবু বকরের মেয়ে ‘আয়িশা। অনেকে এই বর্ণনাটিকে ভিত্তিহীন মনে করেছেন।
আবদুল্লাহ ছিলেন ‘আয়িশার (রা) বোন আসমার (রা) ছেলে। ইতিহাসে তিনি আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর নামে প্রসিদ্ধ। কুনিয়াত হয় কোন সন্তানের নামের সাথে। আয়িশা (রা) ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তাঁর কোন কুনিয়াত ও ছিল না। সেকালের আরবে কুনিয়াত ছির শরাফত ও আভিজাত্যের প্রতীক। অভিজাত শ্রেণীর লোকদের নাম ধরে ডাকার নিয়ম ছিল না। কুনিয়াত বা উপনামেই তাদেরকে সম্বোধন করা হতো। একদিন আয়িশা (রা) স্বামী রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আপনার অন্য স্ত্রীগণ তাঁদের পূর্বের স্বামীদের সন্তানদের নামে নিজেদের কুনিয়াত ধারণ করেছেন, আমি কার নামে কুনিয়াত ধারণ করি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমার বোনের ছেলে আবদুল্লাহর নামে। সেই দিন থেকে তাঁর কুনিয়াত বা ডাকনাম হয় ‘উম্মু ‘আবদিল্লাহ’-‘আবদুল্লাহর মা।
একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আয়িশা (রা) একটি পুত্র সন্তানের মা হন এবং শিশুকালেই তাঁর মৃত্যু হয়। তার নাম রাখা হয় ‘আবদুল্লাহ। সেই সন্তানের নামেই তাঁর কুনিয়াত হয়। ইবন হাজার ‘আসিকিলানী-বলেন, এ বর্ণনা সঠিক নয়। তাছাড়া বিভিন্ন সহীহ হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ কয়েছে যে, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
আয়িশার (রা) পিতা খলীফাতু রাসূলিল্লাহ, আস্-সিদ্দীকুল আকবর আবু বকর (রা) এবং মাতা উম্মু রূমান যয়নাব বিনত ‘আমের, মতান্তরে ‘উমাইর আলী-কিনানী। পিতার দিক দিয়ে তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু তাইম শাখার এবং মাতার দিক দিয়ে বনু কিনানার সন্তান। মা গানাম ইবন মালিক কিনানার মেয়ে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আয়িশার (রা) বংশধারা পিতৃকূলের দিক দিয়ে উপরের দিকে সপ্তম/অষ্টম পুরুষে এবং মাতৃকূলের দিক দিয়ে একাদশ/দ্বাদশ পুরুষে মিলিত হয়েছে।
‘আয়িশা (রা) পিতা আবু বকর (রা) হিজরী ১৩ সনে ইনতিকাল করেন। মা উম্মু রুমান সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, তিনি পাঁচ অথবা ছয় হিজরীতে ইনতিকাল করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কবরে নেমে তাঁকে দাফন করেন এবং জানাযার নামায পড়েন। কিন্তু এ তথ্য সঠিন নয়। কারণ, নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, তিনি উসমানের (রা) খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। হিজরী ৬ষ্ঠ সনের ইফক (‘আয়িশার (রা). চরিত্রে কলম্ব আরোপ)-এর ঘটনা সংক্রান্ত সকল হাদীসে তাঁর নাম এসেছে। হিজরী নবম সনের ‘তাখঈর’ (যে কোন একটি জিনিস বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার)-এর ঘটনার সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন। এ কথা তাবাকাত, বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের বর্ণনা সমূহে জানা যায়। ইমাম বুখারী ‘তারীখে, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের বর্ণনা সমূহে জানা যায়। ইমাম বুখারী তারীখে সাগীর’ গ্রন্থে তাঁর নামটি ঐ সকল লোকদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন যাঁরা হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতকালে ইনতিকাল করেন। তিনি প্রথম বর্ণনাটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। হাফেজ ইবন হাজার আত-তাহযীব’ গ্রন্থে একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করে প্রমাণ করেছেন যে, ইমাম মুখারীর বর্ণনা সঠিক।
‘আয়িশার (রা) মা উম্মু রূমানের (রা) প্রথম বিয়ে হয় ‘আবদুল্লাহ ইবন আল-হারিস আল-আযদীর সাথে। আবদুল্লাহ স্ত্রী উম্মু রূমানকে নিয়ে মক্কায় আসেন এবং আবু বকরের সাথে মৈত্রী চুক্তি করে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। এটা ইসলাম-পূর্ব কালের কথা। আত-তুফাইল নামে তাঁদের একটি পুত্র সন্তান হয়। আবদুল্লাহ মারা যান এবং আবু বকর (রা) উম্মু রূমানকে বিয়ে করেন। এখানে তাঁর দুইটি সন্তান হয়-আবদুল্লাহ ও আয়িশা। হযরত আয়িশার (রা) জন্মের সঠিক সময়কাল সম্পর্কে তারিখ ও সীরাতের গ্রন্থবলীতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। এ কারণে তাঁর জন্মসন সম্পর্কে বেশ মতপার্থক্য দেখা যায়। সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদবী বলেনঃ ঐতিহাসিক ইবন সা‘দ লিখেছেন এবং কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞ তাঁকে অনুসরণ করে বলেছেন নুবুওয়াতের চতুর্থ বছরের সূচনায় আয়িশা জন্মগ্রহণ করেন এবং দশম বছরে ছয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু এ কথা কোনভাবেই সঠিক হতে পারে না। কারণ নুবুওয়াতের চতুর্থ বছরের সূচনায় তাঁর জন্ম হলে দশম বছরে তাঁর বয়স ছয় বছর নয়, বরং সাত বছর হবে। মূলত আয়িশার (রা) বয়স সম্পর্কে কয়েকটি কথা সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত। তা হলো, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে ছয় বছর বয়সে বিয়ে হয়। প্রথম হিজরীর শাওয়াল মাসে নয় বছর বয়সে স্বামী গৃহে যান এবং এগারো হিজরীর রাবীউল আওয়াল মাসে আঠারো বছর বয়সে বিধবা হন। এই হিসাবে তাঁর জন্মের সঠিক সময়কাল হবে নুবুওয়াতের পঞ্চশ বছরের শোষের দিক। অর্থাৎ হিজরাত পূর্ব নবম সনের শাওয়াল মাসে, মুতাবিক জুলাই, ৬১৪ খ্রিস্টাব্দ।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেইশ বছরের নুবুওয়াতী জীবনের প্রায় তেরো বছর মক্কায় এবং দশ বছর মদীনায় অতিবাহিত হয়। নাদবী সাহেবের বর্ণনা, মতে আয়িশার (রা) যখন জন্ম হয় তখন নুবুওয়াতের চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে পঞ্চম বছর চলছে। ইমাম জাহাবী বলেনঃ আয়িশা (রা), ফাতিমার চেয়ে আট বছরের ছোট। আয়িশা বলেছেন, তিনি মক্কায় একজন বৃদ্ধ অন্ধ হাতী চালকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।
‘আয়িশা (রা) কখন কিভাবে মুসলমান হয় সে সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হযরত সিদ্দীকে আকবরের (রা) বড় সৌভাগ্য যে, তাঁরই গৃহে সর্বপ্রথম ইসলামের আলো প্রবেশ করে। এই কারণে হযরত আয়িশা ঐ সকল ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী নর-নারীদের একজন যাঁদের কর্ণকুহরে মুহূর্তের জন্যও কুফর ও শিরকের আওয়াযয পৌঁছেনি। আয়িশা (রা) বলেনঃ যখন থেকে আমি আমার বাবা-মাকে চিনেছি তখন থেকেই তাঁরদেরকে মুসলমান পেয়েছি। ইমাম জাহাবী শুধু বলেছেনঃ আয়িশা ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু কখন কিভাবে, তা বলেননি। ইবন হিশাম যাঁরা আবু বকরের (রা) হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন, তাঁদেরকে একটা স্বতন্ত্র শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। সেখানে আয়িশার (রা) নামটিও এসেছে।
আয়িশাকে (রা) ওয়ায়িল-এর স্ত্রী দুধপান করান। এই ওয়ায়িল-এর ডাকনাম ছিল আবুল ফুকায়‘য়াস। তাঁর ভাই আফলাহ-যিনি আয়িশার দুধচাচা-পরবর্তীকালে মাঝে মাঝে ‘আয়িশার (রা) সাথে দেখা করতে আসতেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি নিয়ে ‘আয়িশা (রা) তাঁর সামনে যেতেন। তাঁর দুধ-ভাইও মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন।
আয়িশার (রা) বাল্যজীবন অন্যসব শিশুদের মতই কেটেছে। তবে একটু ভিন্নতর ছিল। বাল্যকালেই তার তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যসব শিশুদের মত খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। সমবয়সী প্রতিবেশী মেয়েরা তাঁর কাছে আসতো এবং তিনি অধিকাংশ সময় তাদের সাথে খেলতেন। কিন্তু সেই বয়সে খেলার মধ্যেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মান ও মর্যাদার প্রতি সজাগ থাকতেন। অনেক সময় এমন হতো যে, তিনি অন্যদের সাথে পুতুল নিয়ে খেলছেন, এমন সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের গৃহে এসেছেন এবং হঠাৎ তাঁদের মধ্যে হাজির হয়েছেন। ‘আয়িশা (রা) পুতুলগুলি তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলতেন এবং অন্য সাথীরা রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখা মাত্র ছুটে পালাতো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিশুদের ভালোবাসতেন। তাঁদের খেলাধুলাকেও খারাপ মনে করতেন না। তিনি পালিয়ে যাওয়া শিশুদের ডেকে ডেকে ‘আয়িশার সাথে খেলতে বলতেন। শিশুদের খেলাগুলির মধ্যে দুইটি খেলা ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। পুতুল খেলা ও দোল খাওয়া। একদিন ‘আয়িশা (রা) পুতুল নিয়ে খেলছেন, এমন সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসে পড়লেন। পুতুলুগুলির মধ্যে একটি দুই ডানাওয়ালা ঘোড়াও ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ঘোড়ার তো কোন ডানা হয় না। ‘আয়িশা সাথে সাথে বলে উঠলেনঃ কেন? সুলায়মান আলাইহিস সালামের ঘোড়াগুলির তো ডানা ছিল-একথা কি আপনি শোনেনি? ‘আয়িশার (রা) এমন উপস্থিত জবাব শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনভাবে একটু হেসে দেন যে, তাঁর দাঁত দেখা যায়।
এই ঘটান দ্বারা ‘আয়িশার (রা) স্বাভাবগত উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের জ্ঞান, এবং তীক্ষ্ণ মেধার অনুমান করা যায়।
সাধারণত শৈশবকালের কথা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিন্তু ‘আয়িশার (রা) ছোটবেলার সব কথাই স্মৃতিতে ছিল। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন তখন ‘আয়িশার (রা) বয়স আট/নয় বছরের বেশি হবে না। কিন্তু হিজরাতের ঘটনার যত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা আর কোন সাহাবী দিতে পারেননি।
ইমাম বুখারী সূরা আল-কামার-এর তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। ‘আয়িশার (রা) বলেন, যখন এই আয়াতঃ
মক্কায় নাযিল হয় তখন আমি ছোট্ট মেয়ে, খেলছিলাম। ছোটবেলায় হযরত ‘আয়িশার (রা) মাঝে মাঝে মাঝে ক্ষেপিয়ে তুলতেন। তিনিও মেয়েকে শাস্তি দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতে কষ্ট অনুভব করতেন। একবার তিনি উম্মু রূমানকে বলেন, আমার খাতিরে তাকে আর শাস্তি দিবেন না। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার পিতৃগৃহে এসে দেখেন, দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে ‘আয়িশা কাঁদছেন। তিনি উম্মু রূমানকে বলেন, আপনি আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। উম্ম রূমান বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ‘‘ এ মেয়ে আমার বিরুদ্ধে তার বাপের কাছে লাগায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যা কিছুই করুক না কেন, তাকে কষ্ট দিবেন না। আল্লামাহ সাইয়্যেদ সুলায়মান নাদবী ‘মুসতাদরিকে হাকেম’-এর বরাত দিয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমা স্ত্রী হযরত খাদীজা বিন্ত খুওয়াইলিদ। তাঁকে বিয়ে করার সময় রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স ছির পঁচিশ এবং খাদীজার (রা) চল্লিশ। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে পঁচিশ বছর ঘর করার পর নুবুওয়াতের দশম বছর রমযান মাসে হিজরাতের তিনি বছর পূর্বে খাদীজা (রা) ইনতিকাল করেন। তখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স পঞ্চাশ এবং খাদীজার পঁয়ষট্টি।
সাওদার (রা) জীবনীতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, খাদীজার (রা) ইনতিকারের পর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিমর্ষ দেখে ‘উসমান ইবন মাজে’উনের স্ত্রী খাওলা বিনত হাকীম বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি আবার বিয়ে করুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে চাইলেন-কাকে? খাওলা বললেনঃ বিধবা ও কুমারী দুই রকম পাত্রীই আছে। যাকে আপনার পছন্দ হয় তাঁর বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার জানতে চাইলেনঃ তারা কারা? খাওলা বললেনঃ বিধবা পাত্রীটি সাওদা বিনত যাম‘আ, আর কুমারী পাত্রীটি আবু বকরের মেয়ে ‘আয়িশা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ভালো। তুমি তার সম্পর্কে কথা বলো।
হযরত খাওলা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মতি পেয়ে প্রথমে আবু বকরের (রা) বাড়ী এসে প্রস্তাব দেন। জাহিলী আরবের রীতি ছিল, তারা আপন ভাইয়ের সন্তানদের যেমন বিয়ে করতো না, তেমনি সৎ ভাই, জ্ঞাতি ভাই বা পাতানো ভাইয়ের সন্তানদেরকেও বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না। এ কারণে প্রস্তাবটি শুনে আবু বকর বললেনঃ খাওলা! আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাতিজী। তার সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ে হয় কেমন করে? খাওলা (রা) ফিরে আসতেন এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আবু বকর আমার দীনী ভাই। আর এ ধরনের ভাইদের সন্তানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। আবু বকর (রা) প্রস্তাব মেনে নেন এবং খাওলাকে বললেন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে আসতে।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ‘আয়িশার (রা) বিয়ের প্রস্তাব আসার আগে জুবাইর ইবন মুত‘ইম ইবন আদীর সাথে তাঁর বিয়ের কথা হয়েছিল। এ কারণে তার কাছেও জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিল। হযরত আবু বকর (রা) মুত‘ইম ইবন আদীর আছে যেয়ে বললেনঃ তুমি তোমার ছেলের সাথে ‘আয়িশার বিয়ের প্রস্তাব করেছিল। এখন তোমাদের সিদ্ধান্ত কী, বল? মুত‘ইম তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন। মুত‘ইমের পরিবার তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। এ কারণে তাঁর স্ত্রীর এ প্রস্তাবে মত নেই। তখন আবু বকর (রা) মুত‘ইমের দিকে ফিরে বললেনঃ আমার এ প্রস্তাবে মত নেই। তখন আবু বকর (রা) মুত‘ইমের দিকে ফিরে বলরেনঃ তোমার স্ত্রী কী বলে? মুত‘ইম বললেনঃ সে যা বলেছে, আমারও মত তাই। তারপর ফিরে এসে সে খাওলাকে বললেনঃ আপনি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে আসুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন এবং আবু বকর বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। বালাজুরী অবশ্য অন্য কারো সাথে ‘আয়িশার প্রস্তাবের কথা সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন।
‘আয়িশা (রা) ও সাওদার (রা) বিয়ে একই সময় হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাওদাকে বিয়ের পরই ঘরে তুলে নেন এবং শুধু তাঁকে নিয়ে তিন বছর ঘর করার পর ‘আয়িশাকে (রা) ঘরে নিয়ে আসেন।
এই বিয়ে অতি সাদামাটা ও অড়ম্বরহীনভাবে সম্পন্ন হয়। ‘আতিয়্যা (রা) এই বিয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-‘আয়িশা অন্য মেয়েদের সাথে খেলছিলেন। তাঁর সেবিকা এসে তাঁকে নিয়ে যায় এবং আবু বকর (রা) এসে বিয়ে পড়িয়ে দেন।’
এই বিয়ে যে কত অনাড়ম্বর ও অনুষ্ঠানহীন অবস্থায় শেষ হয়েছিল তা অনুমান করা যায় খোদ ‘আয়িশার (রা) একটি বর্ণনা দ্বারা। তিনি বলছেনঃ যখন আমার বিয়ে হয়, আমি কিছুই জানতাম না। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর মা আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেন।
‘আয়িশা (রা) বলেনঃ বিয়ের সময় আমি এক ছোট্ট মেয়ে। ‘হাওফ’ নামক এক প্রকার পোশাক পরি। বিয়ের পর ছোট্ট হওয়া সত্ত্বেও আমার মধ্যে লজ্জা এসে যায়। উল্লেখ্য যে, ‘হাওফা’ হলো চামড়ার তৈরি পায়জামার মত এক ধরণের পোশাক, যা শিশুদের মাঝদেহ বরাবর পরা থাকে। ‘আয়িশারকে (রা) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কত দেন মাহর দান করেছিলেন, সে বিষয়ে মত পার্থক্য আছে। ইবন সা‘দের বর্ণনাসমূহের মাধ্যমে জানা যায়, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোহর হিসেবে ‘আয়িশাকে (রা) একটি ঘর দান করেন যার মূল্য ছির পঞ্চাশ দিরহাম। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন চারশো’ দিরহামের কথা। ইবন সা‘দের অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, যা খোদ ‘আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ মাহর ছিল বারো উকিয়া ও এক নশ-যা পাঁচশো দিরহামের সমান। সহীহ মুসলিমে আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীগণের মোহর সাধারণত পাঁচশো দিরহাম হতো। মুসনাদে আহমাদে ‘আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর মাহর ছিল পাঁচশো।
‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করার পূর্বেই রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুসংবাদ লাভ করেছিলেন। একদিন স্বপ্নে দেখেন যে, এক ব্যক্তি কোন একটি জিনিস এক টুকরো রেশমে জড়িয়ে তাঁকে দেখিয়ে বললেন, এটি আপনার। তিনি খুলে দেখেন তার মধ্যে ‘আয়িশা (রা)।
‘আয়িশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তিন রাত আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম। একজন ফিরিশতা রেশমের একটি খন্ডে কিছু একটা মুড়ে এনে বললো, এ আপনার স্ত্রী। মাথার দিক থেকে আমি খুলে দেখলাম, তার মধ্যে তুমি। আমি বললাম, এ যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তাহলে হোক।
ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ জিবরীল (আ) তাঁর একটি প্রতিকৃতি সবুজ রেশমের একটি টুকরোয় জড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট নিয়ে এসে বলেনঃ ইনি হবেন দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার স্ত্রী।
‘আয়িশার (রা) বিয়ের সঠিক সময়কাল নিয়ে একটু মতভেদ আছে। আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আয়নী সহীহ আল-বুখারীর ভাষ্যে লিখেছেনঃ ‘আয়িশার (রা) বিয়ে হিজরাতের দুই বছর পূর্বে, আবার বলা হয়ে থাকে তিন বছর পূর্বে এবং একথাও বলা হয়েছে যে, দেড় বছর পূর্বে হয়েছিল’ কিছু কিছু বর্ণনায় জানা যায়, খাদীজার (রা) ইনতিকালের তিন বছর পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করেন। কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞ বলেন, যে বছর খাদীজার (রা) মৃত্যু হয় সেই বছর ‘আয়িশার (রা) বিয়ে হয়।
সুলায়মান নাদবী বলেনঃ খাদীজার (রা) ওফাতের তারিখ দ্বারা ‘আয়িশার (রা) বিয়ের সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু খাদীজার (রা) ওফাতের তারিখও সর্বসম্মত নয়। সেখানেও মতভেদ আছে। এ ক্ষেত্রে খোদ ‘আয়িশার (রা) বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু বুখারী ও মুসনাদে তাঁর থেকেও ভিন্ন দুইটি বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বর্ণনায় এসেছে খাদীজার (রা) ওফাতের তিন বছর পর তাঁর বিয়ে হয়। অপর বর্ণনাটিতে খাদীজার (রা) ওফাতের বছরে বিয়ের কথা এসেছে।
অধিকাংশ গবেষকের সিদ্ধান্ত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহের গরিষ্ঠ অংশ যা সমর্থন করে তা হলো, খাদীজা (রা) নুবুওয়াতের দশম বছরে হিজরাতের তিন বছর পূর্বে রমযান মাসে ইনতিকাল করেন এবং তার এক মাস পরে শাওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) বিয়ে করেন। তখন ‘আয়িশার (রা) বয়স ছয় বছর। এই হিসাবে হিজরাত পূর্ব তিন সনের শাওয়াল, মুতাবিক ৬২০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ‘আয়িশার (রা) বিয়ে হয়। আল-ইসতী‘য়ার গ্রন্থাগার ইবন ‘আবিদল বার এই মত সমর্থন করেছেন। মূলত বিয়ে হয়েছিল খাদীজার (রা) ওফাতের বছরেই এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় তিন বছর পরে যখন নয় বছর বয়সে তাঁকে ঘরে তুলে নেন। ‘আয়িশার (রা) একটি বর্ণনা যা ইবন সা’দ নকল করেছেন, তাতে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিয়ের পর ‘আয়িশা (রা) প্রায় তিন বছর পিতৃগৃহে অবস্থান করেন। দুই বছর তিন মাস মক্কায় এবং সাত/আট মাস হিজরাতের পর মদীনায়।
মক্কায় পৌত্তলিকদের যুলুম-নির্যাতনের মাত্রা যখন সহ্যের সীমা ছেড়ে গেল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মদীনায় হিজরাতের সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘আয়িশা (রা) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আবু বকরের গৃহে আসতেন। একদিন অভ্যাসের বিপরীতে চাদর দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে দুপুরের সময় উপস্থিত হন। আবু বকরের (রা) কাছে তখন তাঁর দুই মেয়ে ‘আয়িশা ও আসমা বসা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আবু বকর! আপনার কাছে বসা লোকগুলিকে একটু সরিয়ে দিন, আমি কথা বলতে চাই। আবু বকর বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখানে অন্য কেউ নেই। আপনারই ঘরের লোক। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসলেন এবং হিজরাতের সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেন। ‘আয়িশা ও আসমা দুই বোন মিলে সফরের জিনিসপত্র গোছগাছ করেন। তারপর দুইজন মদীনার পথ ধরেন। তাঁরা তাঁদের পরিবার-পরিজনকে মক্কায় শক্রদের মধ্যে ছেড়ে যান।
মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা থেকে পরিবার-পরিজনকে মদীনায় নেওয়ার জন্য যায়িদ ইবন হারিসা (রা) ও আবু রাফেহকে (রা) মক্কায় পাঠান। তাঁদেরকে দুইটি উট ও পাঁচশো দিরহাম দেন-যা আবু বরক (রা) রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রয়োজন পূরনের জন্য দিয়েছিলেন। আবু বকরও (রা) তাঁদের সাথে আবদুল্লাহকে বলে পাঠান যে, সে যেন ‘আয়িশা, আসমা এবং তাঁদের মা উম্মু রূমানকে নিয়ে মদীনায় চলে আসে।
এই সকল লোক যখন মক্কা থেকে যাত্রা করেন তখন তালহা ইবন ‘আবদিল্লাহ হিজরাতের উদ্দেশ্যে তাঁদের সহযাত্রী হন। আবু রাফে’ ও যায়িদ ইবন হারিসার সঙ্গে ফাতিমা, উম্ম কুলসুম, সাওদা বিনত যাম‘আ উম্ম আয়মান ও উসামা ইবন যায়িদ এবং ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী বকরের (রা) সঙ্গে উম্ম রূমান, ‘আবদুল্লাহর দুই বোন-‘আয়িশা ও আসমা ছিলেন।
এই কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা করেন যখন হিজাযের বনু কিনানার আবাসস্থল আল-বায়দ’ পৌঁছে তখন ‘আয়িশা (রা) ও তাঁর মা উম্মু রূমান (রা) যে উটের আরোহী ছিলেন সেই উটটি তাঁদের নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে পালালো। প্রতি মুহূর্তে তাঁরা আশংকা করতে থাকেন, এই বুঝি হাওদাসহ ছিটকে পড়ছেন। মেয়েদের যেমন স্বভাব, মার নিজের জানের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কলিজার টুকরা ‘আয়িশার (রা) জন্য অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। অনেক দূর যাওয়ার পর উটটি ধরে বশে আনা হয়। সবাই নিরাপদে ছিলেন এবং নিরাপদেই মদীনায় পৌঁছেন। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মসজিদে নববী ও তার আশে-পাশে ঘর-বাড়ী নির্মাণ করছিলেন। তারই একটি ঘরে সাওদা (রা) এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের থাকার ব্যবস্থা হয়।
‘আয়িশা (রা) আপনজনদের সাথে মদীনার বনু হারেস ইবন খাযরাজের মহল্লায় অবতরণ করেন এবং সাত-আট মাস সেখানে মায়ের সাথে বসবাস করেন। মক্কা থেকে মদীনায় আগত অধিকাংশ মুহাজিরের নিকট মদীনার আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। বহু নারী-পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবু বকর (রা) ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন। অল্প বয়সী মেয়ে ‘আয়িশা (রা) পিতার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এসে পিতার অবস্থা জানালে তিনি আবু বকরের (রা) জন্য দু‘আ করেন। আবু বকর (রা) সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পিতাকে সুস্থ করে তোলার পর ‘আয়িশা (রা) নিজেই শয্যা নিলেন। এবার পিতা মেয়ের সেবায় মনোযোগী হলেন। আবু বকর (রা) অসুস্থ মেয়ের শয্যার কাছে যেতেন এবং অত্যন্ত দরদের সাথে তাঁর মুখে মুখ ঘঁষতেন। অসুস্থতা এত মারাত্মক ছিল যে, ‘আয়িশার (রা) মাথার প্রায় সব চুল পড়ে যায়।
বিপদ-আপন থেকে মুক্ত হওয়ার পর আবু বকর (রা), মতান্তরে উম্মু রূমান (রা) একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার স্ত্রীকে ঘরে তুলে নিচ্ছেন না কেন? রাসূলুল্লাহ বললেনঃ এখন আমার হাতে মোহর আদায় করার মত অর্থ নেই। আবু বকর (রা) বললেনঃ আমার অর্থ গ্রহণ করুন। আমি ধার দিচ্ছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারো উকিয়া ও এক নশ (= পাঁচশো দিরহাম) আবু বকরের (রা) নিকট থেকে ধার নিয়ে ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দেন।
মদীনা ছিল যেন ‘আয়িশার শ্বশুর বাড়ী। আনসারী মহিলারা নববধূকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আবু বকরের (রা) গৃহে আসলেন। ‘আয়িশা (রা) তখন বাড়ীর আঙ্গিনায় খেজুর গাছে রতলায় অন্য মেয়েদের সাথে খেলছেন। মা উম্মু রমান (রা) তাকে ডাকলেন। মায়ের ডাক কানে যেতেই হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসেন। তারপর সেই কক্ষে নিয়ে যান যেখানে অতিথি মহিলারা তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিলেন। নব বধূ কক্ষে প্রবেশ করতেই মহিলারা বলে উঠলেনঃ তোমার আগমন শুভ ও কল্যাণময় হোক। তাঁরা নববধুকে সাজালেন। কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত হলেন।
এক পেয়ারা দুধ ছাড়া সেই সময় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে আর কিছুই উপস্থাপন করা হয়নি। আসমা বিনত ইয়াযীদ ছিলেন ‘আয়িশার (রা) একজন খেলার সাথী। তিনি বলেছেন, আমি ছিলাম ‘আয়িশার বান্ধবী। আমি তাকে সাজিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট উপস্থাপন করেছিলাম। আমার সাথে অন্যরাও ছিল। আমরা এক পেয়ালা দুধ ছাড়া সেই সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে দেওয়ার মত আর কিছুই পাইনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়ালা থেকে সামান্য একটু দুধ মুখে দিয়ে ‘আয়িশার দিকে এগিয়ে দেন। ‘আয়িশা নিতে লজ্জা পাচ্ছে দেখে আমি তাকে বললামঃ ‘রাসূলুল্লাহর দান ফিরিয়ে দিওনা।’ তখন সে অত্যন্ত লাজুক অবস্থায় গ্রহণ করে এবং সামান্য পান করে রেখে দিতে যায়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেনঃ তোমার সাথীদের দাও। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ সময় আমাদের পান করার ইচ্ছা নেই। তিনি বললেনঃ মিথ্যা বলবে না। মানুষের প্রতিটি মিথ্যা লেখা হয়। অপর একটি বর্ণনায় এসেছেঃ ক্ষুধা ও মিথ্যা একত্র করো না। মিথ্যা লেখা হয়। এমন কি ছোট ছোট মিথ্যাও।
সহীহ বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে একথা জানা যায় যে, ‘আয়িশার (রা) স্বামীগৃহে গমন হয় প্রথম হিজরীর শাওয়ার মাসে। ‘আল্লামা ‘আয়নী লিখেছেন, হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর তিনি স্বামীগৃহে যান। এ ধরনের একটি কথা ‘আয়িশা (রা) থেকেও বর্ণিত আমাকে হিজরাতের তিন বছর পূর্বে বিয়ে করেন এবং হিজরতের আঠারো মসের মাথায় শাওয়াল মাসে আমার সাথে বাসর করেন। বিয়ের সময় আমি ছয় বছরের এবং বাসরের সময় নয় বছরের এক মেয়ে। কিন্তু এ বর্ণনা সঠিক হতে পারে না। কারণ, এই বর্ণনার ভিত্তিতে ‘আয়িশার (রা) তখন বয়স হবে দশ বছর। অথচ হাদীস ও ইতিহাসের সকল গ্রন্থ এ ব্যাপারে একমত যে, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল নয় বছর।
‘আয়িশার (রা) বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন উভয় কাজই সম্পন্ন হয় শাওয়াল মাসে। এ কারনে তিনি আজীবন এ ধরনের অনুষ্ঠান শাওয়াল মাসে করতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেনঃ আমার বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন-দুটোই হয় শাওয়ালে। আর এ কারণে স্বামীর নিকট আমর চেয়ে অধিক ভাগ্যবতী আর কে ছিল।
রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে নববীর পাশে নির্মিত ছোট্ট একটি ঘরে ‘আয়িশাকে (রা) এনে উঠান। আজ যেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুয়ে আছেন সেটাই ‘আয়িশার (রা) ঘর। পরবর্তীকালে ‘আয়িশা (রা) বলতেনঃ এখন আমি যে ঘরে আছি, আমার এই ঘরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে প্রথম এনে উঠান। তিনি এখানেই ওফাত পেয়েছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের দরজা সোজাসুজি মসজিদের একটি দরজা বানিয়ে নেন। পূর্বের বর্ণনাসমূহ থেকে প্রত্যেকেই বুঝতে পারে, ‘আয়িশার (রা) বিয়ে, স্বামীগৃহে গমন, তথা প্রতিটি অনুষ্ঠান কত আড়ম্বরহীন ও সাদামাটা ছিল। তাতে অতিরঞ্জিত প্রদর্শনী বা বাহুল্য ভাবের কিছু ছিল না।
‘আয়িশার (রা) বিয়ের মাধ্যমে তৎকালীন আরবের বহু কূসংস্কার ও কু-প্রথার বিলোপ ঘটে। তারা সকল প্রকার ভাই, এমনকি মুখে বলা ভাইয়ের মেয়েকেও বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না। এ কারণে খাওলার (রা) প্রস্তাব শুনে আবু বকর (রা) বলে ওঠেনঃ এটা কি বৈধ? ‘আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাতিজী। একথা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে গেলে তিনি ভাতিজী। একথা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে গেলে তিনি বললেনঃ আবু বকর আমার ইসলামী ভাই। তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে বৈধ।
আর একটি কুপ্রথা হলো, শাওয়াল মাসে তারা বিয়ে-শাদী করতোনা। অতীতে কোন এক শাওয়াল মাসে আরবে প্লেগ দেখা দেয়। এ কারণে তারা এ মাসটিকে অশুভ বলে বিশ্বাস করতো এবং এ মাসে তারা কোন বিয়ের অনুষ্ঠান করতো না।
তৎকালীন আরবের কিছু লোকের এ বিশ্বাসও ছিল যে, এ মাসে নববধূকে ঘরে আনলে তাদের সম্পর্ক টেকে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এমন বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে ‘আয়িশার (রা) এ বিয়ে কুঠারাঘাত করে। নববধূকে ঘরে আনার অনুষ্ঠানটি হয় দিনের বেলায়। এটাও ছিল প্রচলিত প্রথার বিপরীত।
আরেকটি প্রথা ছিল দুলহানের আগে আগে তারা আগুন জ্বালাতো। নব দস্পতির প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হতো কোন মঞ্চে অথবা অভ্যন্তরে। এই সকল কুপ্রথার মূলোৎপাটন ঘটে এই বিয়ের মাধ্যমে।----==----
# == # শিক্ষা-দীক্ষা
প্রাচীন আরবে যেখানে পুরুষদেরই লেখা-পড়ার কোন প্রচলন ছিল না সেখানে মেয়েদের তো কোন প্রশ্নই আসেনা। ইসলামের সূচনাকালে মক্কার গোটা কুরাইশ খান্দানে মাত্র ১৭ (সতেরো) ব্যক্তি লিখতে-পড়তে জানতো। তাদের মধ্যে একজন মাত্র মহিলা ছিলেন-শিফা বিনত ‘আবদিল্লাহ। ইসলাম পড়া-লেখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় খুব দ্রুত এর প্রসার ঘটে।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীগণের মধ্যে হাফসা (রা) ও উম্মু সালামা (রা) কিছু লেখাপড়া জানতেন। হযরত হাফসা (রা) খোদ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশে শিফা বিনত ‘আবদিল্লাহর (রা) নিকট লিখতে ও পড়তে শেখেন। সে সময় আরো কিছু মহিলা সাহাবী লেখাপড়া শেখেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, বিশেষত ‘আয়িশাকে (রা) অপরিণত বয়সে গ্রহণের মধ্যে বহুবিধ কল্যাণ নিহিত ছিল। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্যের বরকত যদিও অগণিত পুরুষকে সৌভাগ্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিচ্ছিল, তথাপি স্বাভাবিক কারণে সাধারণ মহিলারা এ সৌভাগ্য লাভে সক্ষম ছিল না। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীদের মাধ্যমেই তার সাহচর্যের ফয়েজ ও বরকতের রহস্য গোটা বিশ্বের নারী জাতির মধ্যে প্রচালিত ও প্রসারিত হওয়া সম্ভব ছিল।
একমাত্র ‘আয়িশা সিদ্দীকা (রা) ছাড়া অন্য সকল আযওয়াজে মুতাহ্হারাত বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের বাঁধনে আবদ্ধ হন। এদিক দিয়ে একমাত্র ‘আয়িশা (রা) শুধুমাত্র নুবুওয়াতের ফয়েজ ও বরকত লাভে ধন্য হন। শৈশব ও কৈশ্যের বয়স হলো মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের প্রকৃত নময়। সৌভাগ্য বশত এ বয়সের পুরোটা সময় তাঁর নবীর প্রশিক্ষণ লাভ করেন যাতে বিশ্বের মানব জাতির অর্ধেক অংশের জন্য আলোর বার্তিকা হয়ে যান।
গোটা কুরাইশ খান্দানের মধ্যে কুষ্ঠি বিদ্যা ও কাব্যশাস্ত্রে আবু বকর (রা) ছিলেন সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানি ব্যক্তি। ‘আয়িশা (রা) এমন পিতার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন। ফলে বংশগতভাবে তাঁর মধ্যে এ দুইটি শাস্ত্রের প্রীতি ও পারদর্শিতা সৃষ্টি হয়।
হযরত আবু বকর (রা) নিজের সন্তানদের সুশিক্ষা ও আদব-আখলাকে শিক্ষাদেরন প্রতি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। ক্ষেত্র বিশেসে কঠোরতাও করতেন। হাদীস ও সীরাতের গ্রনথাবলীতে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। একবার ছেলে ‘আবদুর রহমানকে মারতে উদ্যত হন শুধু এই কারণে যে, মেহমানদের খাবার দিতে দেরী করেছিলেন। বিয়ের পরেও ‘আয়িশা (রা) নিজের কোন ভুল-ক্রটির জন্য পিতাকে দারুণ ভয় করতেন। অনেক ক্ষেত্রে পিতা তাঁকে ভীষণ বকাঝকা করতেন। মাঝে মধ্যে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করতেন না। একবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বাঁচিয়ে নেন। আর একবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিতিতে ‘আয়িশার (রা) পাঁজরে জোরে থাপপড় মারেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বলে ওঠেনঃ আবু বকর! আল্লাহ আপনাকে মাফ করুন! আমরা এমনটি চাইনি। হযরত ‘আয়িশার (রা) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের প্রকৃত সূচনা হয় স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর। এ সময়ে তিনি পড়তে শেখেন। তিনি দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি লিখতে জানতেন না। হাদীসে এসেছে, তাঁর জন্য কুরআন লেখালেখির কাজ করতেন তাঁর দাস জাকওয়ান। তবে কিছু বর্ণনায় এসেছে-‘অমুক চিঠির জবাবে তিনি একথা লেখেন।’ সম্ভবত বর্ণনাকারীরা ‘লিখিয়েছেন’ কথাটির স্থলে ‘লেখেন’ বলে দিয়েছেন। সাধারণত এমনই হয়ে থাকে। যাহোক, লেখা ও পড়া মানুষের জ্ঞানের বাহ্যিক মাপকাঠি। প্রকৃত জ্ঞানের মাপকাঠি তার থেকে অনেক উঁচু স্তরে। মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতার পূর্ণতা ও পবিত্রতা অর্জন, দীনের আবশ্যকীয় বিষয় ও শরীয়াতের গূঢ় রহস্য জানা এবং আল্লাহর কালাম ও আহকামে নববীর জ্ঞান লাভই হচ্ছে সর্বোত্তম শিক্ষা। হযরত ‘আয়িশা (রা) ছিলেন এই সকল জ্ঞানের ভান্ডার তাছাড়া ইতিহাস, সাহিত্য ও চিকিৎসা বিদ্যায় ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান। ইতিহাস ও সাহিত্যের জ্ঞান অর্জন করেন পিতার নিকট থেকে।চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও স্থান থেকে যে সকল লোকজন ও প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরবারে আসতো তাদের নিকট থেকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলিতে অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকতেন। আরবের চিকিৎসকরা যেখানে যে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিতেন, ‘আয়িশা (রা) স্মৃতিতে তা ধরে রাখতেন।
একদিন ‘উরওয়া ‘আয়িশাকে (রা) বললেনঃ আমি আপনার ফিকহ, কাব্য ও প্রাচীন আরবের ইহিহাসের জ্ঞান দেখে বিস্মিত হই না। কারণ এ জ্ঞান অর্জন আপনার জন্য সম্ভব। কিন্তু আপানর ‘তিবব’ বা চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান দেখে বিস্মিত না হয়ে পারিনা। এ জ্ঞান আপনি কিভাবে ও কোথা থেকে অর্জন করেন? ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ‘উরওয়া! রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর শেষ জীবনে অসুস্থ থাকতেন। আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে তাঁর কাছে লোক আসতো। তারা নানা রকম ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিত। আর আমি সেইভাবে চিকিৎসা করতাম। সেখান থেকেই এই জ্ঞান অর্জন করেছি। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘উরওয়া প্রশ্ন করেনঃ এই তিবেবর জ্ঞান আপনি কোথা থেকে অর্জন করেছেন? আয়িশা (রা) জবাব দেনঃ আমি অথবা অন্য কোন লোক অসুস্থ হলে যে ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়, সেখান থেকে শিখেছি। তাছাড়া একজন আরেকজনকে যেসব রোগ ও ওষুধের কথা বলে আমি তাও মনে রাখি।
দীনী জ্ঞান অর্জনের তো কোন নির্দিষ্ট সময় ছিল না। শরী‘য়াতের মহান শিক্ষক ঘরেই ছিলেন। রাত-দিন তাঁর সাহচর্য লাভে ধন্য হতেন। প্রতিদিন মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা‘লীম ও ইরশাদের মসজিলস বসতো। মসজিদের গাঁ ঘেঁষেই ছিল হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরা। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইরে লোকদের যে শিক্ষা দিতেন, ‘আয়িশা (রা) ঘরে বসেই তাতে শরিক থাকতেন। কখনো কোন কথা দূরত্ব বা অন্য কোন কারণে বুঝতে না পারলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এলে জিজ্ঞেস করে বুঝে নিতেন। কখনো কখনো তিনি মসজিলসের কাছাকাছি চলে যেতেন। তাছাড়া রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সপ্তাহে একটি দিন তাদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করে নেন।
দিবা-রাত্র ইলম ও হিকমাত বা জ্ঞান-বিজ্ঞারে অসংখ্য বিষয়ের আলোচনা তাঁর কানে আসতো। তাঁর নিজেরও অভ্যাস ছিল, প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীন চিত্তে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে উপস্থাপন করা। তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্ত হতেন না। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেওয়া হবে, সে শাস্তি ভোগ করবে।
‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ তো বলেছেন-
অর্থাৎ তার থেকে সহজ হিসাব নেওয়া হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ হলো আমলের উপস্থাপন। কিন্তু যার আমলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে তার ধ্বংস অনিবার্য।
একবার ওয়াজ-নসীহতের সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ কিয়ামতের দিন সকল মানুষ নগ্ন অবস্থায় উঠবে। ‘আয়িশার (রা) মনে খটকা লাগলো। তিনি বলে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! নারী-পুরুষ এক সঙ্গে উঠবে। তাহলে একে অন্যের প্রতি কি দৃষ্টি পড়বে না? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সময়টা হবে অতি ভয়ংকর। অর্থাৎ একজনের অন্যজনের ব্যাপারে কোন খবরই থাকবে না।
একদিন ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, কাফির-মুশরিকরা যে ভালো কাজ করে তার সাওয়াব তারা পাবে কিনা? ‘আবদুল্লাহ ইবন জাদ‘আন নামে মক্কায় একজন সৎ স্বভাব ও কোমল অন্তরের মুশরিক ছিল। সে ইসলাম-পূর্ব যুগে কুরাইশদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-ফাসাদ মীমাংসার উদ্দেশ্যে কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে একটি বৈঠকে সমবেত করে। তাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন। ‘আয়িশা (রা) প্রশ্ন করেনঃ ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আবদুল্লাহ ইবন জাদ‘আন জাহিলী যুগে মানুষের সাথে সদয় ব্যবহার করতো। দরিদ্র ও অনাহারক্লিষ্টদেরকে আহার করাতো। তার এ কাজ কি উপকারে আসবে না?’’ তিনি জবাব দিলেনঃ না, ‘আয়িশা। সে কোনদিন একথা বলেনি যে, হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
জিহাদ ইসলামের একটি অন্যতম ফরয। ‘আয়িশার (রা) ধারণা ছিল, অন্য ফরযের ক্ষেত্রে যেমন নারী-পুরুষের কোন প্রভেদ নেই, তেমনি এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশ্ন করেই বসলেন। উত্তর পেলেনঃ হজ্জ হলো নারীদের জিহাদ।
আর একদিন প্রশ্ন করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! জিহাদ হচ্ছে সর্বোত্তম আমল। আমরা নারীরা কি জিহাদ করবো না? রাসূলুল্লাহ বললেনঃ না। তবে সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে হজ্জে মাবরূর।
বিয়েতে বর-কনে উভয়ের সম্মতি থাকা শর্ত। কুমারী মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে লজ্জায় মুখে সম্মতি প্রকাশ করে না। এ কারণে ‘আয়িশা (রা) একদিন প্রশ্ন করেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! বিয়েতে তো মেয়ের সম্মতি প্রয়োজন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, প্রয়োজন। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ মেয়েরা তো লজ্জায় চুপ থাকে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তার চুপ থাকাই সম্মতি।
একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাজাজ্জুদ নামায আদায়ের পর বিতর না পড়েই বিশ্রামের জন্য একটু শোয়ার ইচ্ছা করলেন। ‘আয়িশা (রা) বলে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি বিতর না পড়েই শুয়ে যাচ্ছেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমার চোখ তো ঘুমায়, কিন্তু অন্তর ঘুমায়না। বাহ্যত ‘আয়িশার (রা) এ ধরনের প্রশ্ন বেয়াদবী বলে মেন হয়। কিন্তু তিনি সাহসিকতা না দেখালে উম্মাতে মুহাম্মাদী নুবুওয়াতের গূঢ় রহস্য থেকে অজ্ঞ থেকে যেত।
ইসলামে প্রতিবেশীর বহু অধিকারের কথা এসেছে। আর এই অধিকারনের সুযোগ আসে বেশীর ভাগ মেয়েদেরই। কিন্তু প্রতিবেশী একাধিক হলে কাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে? তাই ‘আয়িশা (রা) একদিন প্রশ্ন করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেনঃ যে প্রতিবেশীর দরজা তোমার ঘরের অধিক নিকটবর্তী, তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।৭একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে কেউ তো মৃত্যুকে পছন্দ করে না।? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমার কথার এই অর্থ নয়। অর্থ হলো, মুমিন ব্যক্তি যখন আল্লাহর রহমত, রিজামন্দী এবং জান্নাতের অবস্থার কথা শোনে তখন তার অন্তর আল্লাহর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আল্লাহও তার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকেন। আর কাফির ব্যক্তি যখন আল্লাহর আজাব ও অসন্তুটির কথা শোনে তখন সে আল্লাহর সামনে যেতে অপছন্দ করে। আল্লাহও তার সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন।
একবার এক ব্যক্তি যখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো, তিনি অনুমতি দিয়ে বললেনঃ ‘তাকে আসতে দাও। সে তার গোত্রের খুব খারাপ লোক।’ লোকটি এসে বসলো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত ধৈয্য, মনযোগ ও আন্তরিকতা সহকারে তার সাথে কথা বললেন। আয়িশা (রা) খুব অবাক হলেন। লোকটি চলে গেলে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো লোকটিকে ভালো জানতেন না। কিন্তু সে যখন এলো, তার সাথে এমন আন্তরিকতা ও নম্রভাবে কথা বললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! সবচেয়ে খারাপ মানুষ ঐ ব্যক্তি যার ভয়ে মানুষ তার সাথে মেলামেশা ছেড়ে দেয়।
একবার এক ব্যক্তি এসে কিছু সাহায্য চাইলো। হযরত ‘আয়িশার (রা) ইঙ্গিতে দাসী কিছু জিনিস দিতে চললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! গুনে গুনে দিবে না। তাহলে আল্লাহও তোমাকে গুনে গুনে দিবেন। আর একটি টুকরাও যদি হয়, ভিক্ষুককে তাই দিয়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচ। সেটি একজন ক্ষুধার্ত মানুষ খেলে তো কিছু হবে এবং তার পেট ভরবে। এর থেকে আর ভাল কি হতে পারে।
আর একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে দরিদ্র অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখ, দরিদ্র অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং কিয়ামতের দিন দরিদ্রদের সাথেই উঠাও। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ কেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সম্পদহীনরা সম্পদশালীদের চেয়ে চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে। ‘আয়িশা, কোন ভিক্ষুককে কিছু না দিয়ে ফিরিয়ে দিবে না। তা সে খোরমার একটি টুকরাই হোক না কেন। দরিদ্রদের ভালোবাসবে এবং তাদেরকে নিজের পাশে বসাবে।
হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাসমূহ হযরত ‘আয়িশা (রা) এ জাতীয় অসংখ্য জিজ্ঞাসা ও তার জবাব বর্ণিত হয়েছে। মূলতঃ এগুলিই ছিল তাঁর নিত্যদিনের পাঠ। বিভিন্ন নৈতিক উপদেশ ছাড়ও নামায, হজ্জ, যাকাত, তথা দীন ও দুনিয়ার অসংখ্য কথা রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আয়িশাকে (রা) অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে শেখাতেন। ‘আয়িশাও (রা) অতি আগ্রহ সহকারে শিখতেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তা আমল করতেন।
হযরত ‘আয়িশার (রা) মধ্যে জানার আগ্রহ ছিল অতি তীব্র। যে সকল মুহূর্তে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো তখনও তিনি জিজ্ঞসা করা থেকে বিরত থাকতেন না। মূলতঃ তিনি স্বামী হযরত রাসূলে পাকের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বভাব-প্রকৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তাঁর ক্ষেত্রে খোলামেলা ও দুঃসাহসী হতে পারত। একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন কারণের স্ত্রীদের উপর বিরক্ত হয়ে অঙ্গীকার করেন যে, আগামী একমাস কোন স্ত্রীর কাছেই যাবেন না। ঊনত্রিশ দিন এই অঙ্গীকারের উপর অটল থাকেন। ঘটনাক্রমে সেই চন্দ্র মাসটি ছিল ঊনত্রিশ দিনের। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরের মাসের প্রথম তারিখ অর্থাৎ ৩০তম দিনে ‘আয়িশার (রা) নিকট যান। আপতঃদৃষ্টিতে ‘আয়িশা (রা) উল্লাসিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রশ্ন করেছেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বলেছেন, একমাস আমাদের কাছে আসবেন না। একদিন আগে কিভাবে আসলেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! মাস ঊনত্রিশ দিনেও হয়।
সংসার জীবনঃ
হযরত ‘আয়িশা (রা) পিতৃগৃহ থেকে বউ হয়ে যে ঘরে এসে ওঠেন তা কোন আলিশান অট্টালিকা ছিল না। মদীনার বনু নাজ্জার মহল্লার মসজিদে নববীর চারপাশে ছোট্ট ছোট্ট কিছু কাঁচা ঘর ছিল, তারই একটিতে তিনি এসে ওঠেন। ঘরটি ছিল মসজিদের পূর্ব দিকে। তার একটি দরজা ছিল পশ্চিম দিকে মসজিদের ভিতরে। ফলে মসজিদ ঘরের আঙ্গিনায় পরিণত হয়। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। তিনি যখন মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন, মাথাটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন, আর আয়িশা (রা) চুলে চিরুনী করে দিতেন। কখনো মসজিদে বসেই ঘরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কোন কিছু ‘আয়িশার (রা) নিকট থেকে চেয়ে নিতেন।
ঘরটির প্রশস্ততা ছির ছয় হাতেরও বেশি। দেয়াল ছিল মাটির। খেজুর পাতা ও ডালের ছাদ ছিল। তার উপরে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কম্বল দেওয়া যেত। এতটুকু উঁচু ছিল যে, একজন মানুষ দাঁড়ালে তার হাতে ছাদের নাগাল পাওয়া যেত। এক পাল্লার একটি দরজা ছিল, কিন্তু তা কখনো বন্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি। পর্দার জন্য দরজায় একটি কম্বল ঝুলানো থাকতো। এই ঘরের লাগোয়া আর একটি ঘর ছিল-যাকে ‘মাশরাবা’ বলা হতো। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের থেকে পৃথক থাকা কালে এক মাস এখানেই কাটান।
ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল-একটি খাট, একটি চাটাই, একটি বিছানা, একটি বালিশ, খোরমা-খেজুর রাখার দুইটি মটকা, পানির একটি পাত্র এবং পান করার একটি পেয়ালা। এর বেশি কিছু নয়। বিভিন্ন হাদীসে একাধিক স্থানে এইসব জিনিসের নাম বাসিন্দাদের রাতের বেলা একটি বাতি জ্বালানোর সামর্থ ছিল না। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ একাধারে প্রায় চল্লিশ রাত চলে যেত ঘরে বাতি জ্বলতো না।
ঘরে সর্বসাকুল্যে দুইটি মানুষ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশা (রা)। কিছুদিন পর ‘বুরায়রা’ (রা) নাম্নী একজন দাসী যুক্ত হন। যতদিন ‘আয়িশা ও সাওদা মাত্র দুই স্ত্রীই ছিলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন পর পর আয়িশার (রা) ঘরে রাত কাটাতেন। পরে আরো কয়েকজনকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করলে এবং হযরত সাওদা (রা) স্বেচ্ছায় স্বীয় বারির দিনটি আয়িশাকে (রা) দান করলে প্রতি নয় দিনে দুই দিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটাতেন।
ঘর-গৃহস্থালীর গোছগাছ ও পরিপাটির বিশেষ কোন প্রয়োজন পড়তো না। খাদ্য খাবার তৈরি ও রান্নাবান্নার সুযোগ খুব কমই আসতো। হযরত ‘আয়িশা (রা) নিজেই বলতেনঃ কখনো একাধারে তিন দিন এমন যায়নি যখন নবী পরিবারের লোকেরা পেট ভরে খেয়েছেন। তিনি আরো বলতেনঃ মাসের পর মাস ঘরে আগুন জ্বলতো না। এ সময় খেজুর ও পানির উপরই কাটতো। খায়বার বিজয়ের পর হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আযওয়াজে মুতাহহারাতের (পবিত্র সহধর্মিণীগণ) প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক ভাতা নির্ধারণ করে দেন। আবদুর রহমান আল-আ‘রাজ মদীনায় তাঁর মজলিসে বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) জীবিকার জন্য খায়বারের ফসল থেকে আশি ওয়াসাক খেজুর এবং বিশ ওয়াসাক যব মতান্তরে গম দিতেন। কিন্তু তাঁর দানশীলতার কারণে এই পরিমাণ খাদ্য সারা বছরের জন্য কখনো যথেষ্ট ছিল না।
সাহাবায়ে কিরাম (রা) সব সময় নবী-পরিবারে উপহার-উপঢৌকন পাঠাতেন। বিশেষ করে যেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) ঘরে অবস্থান করতেন, লোকেরা ইচ্ছা করেই সেই দিন বেশি করে হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন।
অনেক সময় এমন হতো যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইরে থেকে এসে জিজ্ঞেস করতেনঃ ‘আয়িশা! কিছু আছে কি? তিনি জবাব দিতেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিছুই নেই। তারপর সবাই মিলে রোযা রাখতেন। অনেক সময় কোন কোন আনসার পরিবার দুধ পাঠাতো। তাই পান করেই পরিতৃপ্ত থাকতেন। উম্মু সালামা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সময় আমাদের অধিকাংশ দিনের খাবার ছিল দুধ।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর-গৃহস্থলীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল হযরত বিলালের (রা) উপর। তিনি সারা বছরের খাদ্যশস্য বণ্টন করতেন। প্রয়োজন পড়লে ধার-কর্জ করতেন।
হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ওফাত পান তখন গোটা আরব ইসলামের ছায়াতলে এসে গেছে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ এসে বাইতুলমালে জমা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেদিন ওফাত পান সেদিন হযরত ‘আয়িশার (রা) ঘরে একদিন চলার মতও খাবার ছিল না।
হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) খিলাফতকালেও হযরত ‘আয়িশা (রা) খায়বারে উৎপাদিত ফসল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য পেতেন। খলীফা হযরত ‘উমার (রা) সবার জন্য নগদ ভাতার প্রচলন করেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক দশহাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। কিন্তু ‘আয়িশার (রা) জন্য নির্ধারণ করন বারো হাজার। এর কারণ স্বরূপ তিনি বলতেনঃ ‘আয়িশা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা স্ত্রী। একটি বর্ণনায় এসেছে, খলীফা ‘উমার (রা) তাঁর সময়ে খায়বারে উৎপন্ন ফসলের অংশ অথবা ভূমি গ্রহণের এখতিয়ার দান করেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) তখন ভূমি গ্রহণ করেন।
অর্থ-সম্পদ যা কিছু তাঁর হাতে আসতো-গরীব-মিসকীনদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। খলীফা হযরত উসমান (রা) থেকে নিয়ে আমীর মু‘য়ারিয়া (রা) পর্যন্ত উপরে উল্লেখিত ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) ছিলেন হযরত আয়িশার (রা) ভাগ্নে-যিনি আমীর মু‘য়াবিয়ার (রা) পরে হিজাযের খলীফা হন। তিনি খালার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। কিন্তু যেদিন বাইতুল মাল থেকে ভাতা না আসতো সেদিন তাঁর গৃহে অভূক্ত থাকার উপক্রম হতো।
স্বাভাগত ভাবে হযরত ‘আয়িশার (রা) তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও বোধ থাকা সত্ত্বেও বয়স কম হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে ভুল-ত্রুটি হয়ে যেত। ঘরে গম পিষে আটা বানিয়ে ঘুমিয়ে যেতেন, ছাগল এসে তা খেয়ে ফেলতো। একদিন তিনি নিজ হাতে আটা পিষে রুটি তৈরি করেন। তারপর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসার প্রতীক্ষায় থাকেন। সময়টি ছিল রাতের বেলা। এক সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসলেন এবং নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঘুমে হযরত ‘আয়িশার (রা) চোখ দুইটি বন্ধ হয়ে এলো। এই ফাঁকে প্রতিবেশীর একটি ছাগল ঘরে ঢুকে সবকিছু খেয়ে ফেললো। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বয়স্কা স্ত্রীদের তুলনায় তিনি খাদ্য-খাবার ভালো পাকাতে পারতেন না।----==----
# == # দাম্পত্য জীবন
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশার (রা) যুগল জীবন এবং তাঁদের মধ্যের মধুর সম্পর্কের একটি চিত্র আমাদের সামনে থাকা দরকার। ইসলাম নারীকে না অতি পবিত্র মনে করে দেবীর আসনে বসিয়েছে, আর না তাকে কেবল পুরুষের ভোগের বস্ত্ত বলে মনে করেছে। নারী সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক কালের পৃথিবীর মানুষের ধারণা মূলত এমনই। তাই কোনকালেই কোন সমাজে নারী সঠিক মর্যাদা লাভ করেনি। একমাত্র ইসলামই সঠিক মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম নারীর সর্বোত্তম যে পরিচিতি তুলে ধরেছে তা হচ্ছে, এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বের নারী হলো পুরুষের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার উৎস। কুরআন ঘোষণা করেছেঃ
আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আর রূম-২১)
আল্লাহ পাকের এই ঘোষণার বাস্তব চিত্র আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশার (রা) দাম্পত্য জীবনের মধ্যে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন।
-তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।
তাঁদের নয় বছরে দাম্পত্য জীবনে ছিল গভীর ভালোবাসা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সীমাহীন আবেগ ও নিষ্ঠা। কঠিক দারিদ্র্য, অনাহার, তথা সকল প্রতিকূল পরিবেশেও তাঁদের এ মধুর সম্পর্কে একদিনের জন্যও ফাটল দেখা যায়নি। কোন রকম তিক্তা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়নি।
হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে (রা) গভীরভাবে ভালোবাসতেন। এ কথা গোটা সাহাবী সমাজের জানা ছিল। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেদিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটাতেন সেদিন তাঁরা বেশি বেশি হাদিয়া তোহফা পাঠাতেন। এতে অন্য স্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হতেন। তাঁরা চাইতেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেন লোকদের নির্দেশ দেন, তিনি যেদিন যেখানে থাকেন লোকেরা যেন সেখানেই যা কিছু পাঠাবার, পাঠায়। কিন্তু সে কথা বলার হিম্মত কারো হতো না। এই জন্য তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের মনের কথা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাসূলে পাকের কলিজার টুকরো ফাতিমাকে (রা) বেছে নেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতিমার (রা) বক্তব্য শুনে বললেন, ‘মা, আমি যা চাই, তুমি কি তা চাও না? ফাতিমা পিতার ইচ্ছা বুঝতে পারলেন। তিনি ফিরে এলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীরা আবার তাঁকে পাঠাতে চাইলেন; কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বয়স্কা, বুদ্ধিমতী ও রসিক মহিলা। তিনি বেশ কায়দা করে তাদের মনের কথা রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেনঃ উম্মু সালামা! আয়িশার ব্যাপারে তোমরা আমাকে বিরক্ত বরবে না। কারণ ‘আয়িশা ছাড়া আর কোন স্ত্রীর লেপের নীচে আমার উপর ওহী নাযিল হয়নি। ইমাম জাহাবী বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই জবাব দ্বারা প্রতীয়মান হয়, অন্যদের তুলনায় ‘আয়িশাকে (রা) সর্বাধিক ভালোবাসার অন্যতম কারণ হলো, আল্লাহ্র নির্দেশ। আল্লাহর নির্দেশেই তিনি ‘আয়িশাকে (রা) এত ভালোবাসতেন।
হযরত ‘আমর ইবনুল ‘আস (রা) ‘জাতুস সালাসিল’ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস কররেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ পৃথিবীতে আপনার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? বললেনঃ আয়িশা। তিনি আবার বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার জিজ্ঞাসা পুরুষ সম্পর্কে। বললেনঃ ‘আয়িশার পিতা।
একবার ‘উমার (রা) মেয়ে উম্মুল মুমিনীন হাফসাকে (রা) উপদেশ দিতে গিয়ে বললেনঃ তুমি ‘আয়িশার সাথে পাল্লা দিতে যেও না। কারণ, সে তো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তমা।
একবার এক সফরে চলার পথে ‘আয়িশার (রা) উটনীটি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তাঁকে নিয়ে দৌড় দেয়। এতে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতই অস্থির হয়ে পড়েন যে, তাঁর মুখ দিয়ে তখন উচ্চারিত হতে শোনা যায়ঃ ‘ওয়া আরূসাহ!’ হায়! আমার বধূ!
হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তিম রোগ শয্যায় বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেনঃ আজ কি বার? কক্ষের সবাই বুঝলো, তিনি ‘আয়িশার বারির দিনটির অপেক্ষা করছেন। সুতরাং তাঁকে ‘আয়িশার (রা) ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ওফাত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। ‘আয়িশার (রা) রারে উপর মাথা রেখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তেরো দিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুস্থ ছিলেন। তার মধ্যে পাঁচ দিন অন্য স্ত্রীদের ঘরে এবং আট দিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটান।
পরবর্তীকালে ‘আয়িশা (রা) বলতেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার ঘরে আমার বারির দিনে এবং আমারই বুকে ইনতিকাল করেন। জীবনের একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ‘আবদুর রহমান ইবন আবী বকর (রা) একটি কাঁচা মিসওয়াক হাতে করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতে আসেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই মিসওয়াকটির দিকে বার বার তাকাতে লাগলেন। বুঝলাম, তিনি সেটা চাচ্ছেন। আমি সেটা নিয়ে ধুয়ে নিজে চিবিয়ে নরম করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিলাম। তিনি সেটা দিয়ে সুন্দর করে মিওয়াক করলেন। তারপর আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন, কিন্তু হাতটি পড়ে গেল। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই মহান আল্লাহর প্রশংসা যিনি তাঁর রাসূলের পার্থিব জীবনের শেষ মূহুর্তটিতে তাঁর ও আমার থুতু মিলিত করেছেন।
অনেকে মনে করে থাকে ‘আয়িশার (রা) প্রতি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন আবেগ ও মুগ্ধতার কারণ তাঁর রূপ-লাবণ্য। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। রাসূরে পাকের সহধর্মিণীদের মধ্যে জুওয়াইরিয়া, যায়নাব ও সাফিয়্যা (রা) ছিলেন সর্বাধিক সুন্দরী। তাঁদের সৌন্দর্য্যের কথা হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান। কিন্তু ‘আয়িশার (রা) রূপ লাবণ্যের কথা দুই একটি স্থান ব্যতীত তেমন কিছু উল্লেখ নেই। যেমন একবার উমার (রা) হাফসাকে (রা) উপদেশ দিতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেন। আর তা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটু হেসে দেন। মূলতঃ উমারের এ মন্তব্য দ্বারা এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, ‘আয়িশা (রা) হাফসার (রা) চেয়ে প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য।
আসল কথা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলেছেন, তাই তিনি বলেছেনঃ বিয়ের জন্য কনের নির্বাচন চারটি গুণের ভিত্তিতে হতে পারে।
১. ধন-সম্পদ
২. রূপ-সৌন্দর্য,
৩. বংশ মর্যাদা,
৪. দীনদারী।
তোমরা দীনদারীর সন্ধান করবে। এ কারণে যাঁর দ্বারা দীনের বেশি খিদমাত হওয়া সম্ভব ছিল স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। ‘আয়িশার (রা) সমস্ত-বুঝ, চিন্তা-অনুধ্যান, হুকুম-আহকাম স্মৃতিতে ধারণ ক্ষমতা অন্য স্ত্রীদের তুলনায় অতিমাত্রায় বেশি ছিল। মূলতঃ এসব গুণই তাঁকে স্বামীর প্রিয়তমা করে তুলেছিল। আল্লামা ইবন হাযাম ‘আল-মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করে একথা প্রমাণ করেছেন। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
-পুরুষদের মধ্যে কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জন করেছেন অনেকে, কিন্তু নারীদের মধ্যে মারইয়াম বিনত ইমরান এবং ফির‘আউনের স্ত্রী আসিয়া ছাড়া আর কেউ পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। তবে গোটা নারী জাতির উপর ‘আয়িশার মর্যাদা যাবতীয় খাদ্য সামগ্রীর উপর সারীদের মর্যাদার মত।
‘আয়িশাকে (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত বেশি ভারোবাসার তাৎপর্য এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। তাঁর মুগ্ধতা ‘আয়িশার (রা) রূপ-যৌবন ও সৌন্দর্য ছিল না; বরং তা ছিল তাঁর অন্তর্গত গুণাবলী ও পূর্ণতায়। আর এই অন্তর্গত গুণাবলীতে ‘আয়িশার (রা) পরে স্থান ছিল উম্মু সালামার (রা) এ কারণে বয়স্কা ওহয়া সত্ত্বেও তিনিও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গভীর ভারোবাসার পাত্রী ছিলেন। হযরত খাদীজা (রা) পঁয়ষট্টি বছর বয়স রাভ করে ওফাত পান, অথবা তাঁর ভালোবাসা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হৃদয়ের এত গভীরে ছিল যে, তাতে ‘আয়িশাও (রা) ঈর্ষা পোষণ করতেন।
স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ছিল ‘আয়িশার (রা) বুকভরা পবিত্র ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায় অন্য কেউ ভাগের দাবিদার হলে তিনি কষ্ট পেতেন। কখনো রাতে ‘আয়িশার (রা) ঘুম ভেঙ্গে গেলে পাশে স্বামীকে না পেলে অস্থির হয়ে পড়তেন। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে স্বামীকে পেলেন না। রাতে ঘরে বাতিও জ্বলতো না। অন্ধকারে এদিক ওদিক হাতড়াতে লাগলেন। অবশেষে এক স্থানে স্বামীর কদম মুবারাক খুঁজে পেলেন। তিনি সিজদায় পড়ে আছেন।
আরো একবার একই অবস্থায় অবতারণা হলো। ‘আয়িশা (রা) মনে করলেন, তিনি হয়তো অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গেছেন। তিনি দিক ওদিক দেখতে লাগলেন। দেখলেন, স্বামী এক কোণে নীরবে তাসবীহ পাঠে নিমগ্ন আছেন। ‘আয়িশা (রা) নিজের অমূলক ধারণার জন্য লজ্জিত হলেন। তিনি আপন মনে বলে উঠলেনঃ আমার মা-বাবা উৎসর্গীত হোক! আমি কোন ধারণায় আছি কোন ধারণায় আছি, আর তিনি আছেন কোন অবস্থায়।
অন্য এক রাতের ঘটনা। ‘আয়িশা (রা) মধ্যরাতে জেগে উঠলেন। পাশে স্বামীকে না পেয়ে এখানে সেখানে খোঁজা খোঁজি করতে করতে কবরস্থানে পৌঁছে দেখলেন, তিনি দু‘আ ও ইসতিগফারে নিমগ্ন। তিনি আবার নীরবে ফিরে আসলেন। সকালে একথা স্বামীকে জানালে তিনি বললেনঃ হাঁ, রাতে আমার সামনে দিয়ে কোন একটা জিনিস যাচ্ছিল মনে হয়েছিল। তাহলে সে তুমিই হবে।’
একবার এক সফরে ‘আয়িশা (রা) ও হাফসা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গিনী ছিলেন। রাতে চলার পথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) বাহনের পিঠে বসে তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে চলতেন।
একদিন ‘আয়িশা ও হাফসা (রা) পরামর্শ করে উট বদল করে নিলেন। রাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যথারীতি ‘আয়িশার (রা) উটের পিঠে উঠে এলেন এবং হাফসার (রা) সাথে কথা বলতে বলতে পথ চললেন। এদিকে ‘আয়িশা (রা) স্বামী সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে কাতর হয়ে পড়েন। পরবর্তী মানযিলে কাফেলা থামলে তিনি বাহনের পিঠ থেকে নেমে পড়েন এবং ঘাসের মধ্যে নিজের চরণ দুইখনি ডুবিয়ে দিয়ে আপন মনে বলতে থাকেনঃ ‘হে আল্লাহ! আমি তো আর তাঁকে কিছু বলতে পারিনে। আপনি একটা বিচ্ছু অথবা সাপ পাঠিয়ে দিন, আমাকে দংশন করুন!
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধমির্ণীদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মহিলা ছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ অভিজাত পরিবারের মেয়ে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে এমন দীন-হীন অবস্থায় জীবন যাপন করতে গিয়ে তাঁদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এ জন্য তাঁরা সমবেতভাবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জীবন যাপনের মান বৃদ্ধির আবদার করতে থাকেন। এরই প্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল হয়। যাতে তাঁদেরকে এ চূড়ান্ত কথা বলে দেওয়া হয় যে, যাঁরা ইচ্ছা স্বেচ্ছায় সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে পারেন অথবা এই দীন-হীন অবস্থা মেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে জীবন যাপন করতে পারেন। আয়িশা (রা) ছিলেন যেহেতু কম বয়স্কা, তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে মা-বাবর সাথে পরামর্শ করে জানিয়ে দেন। বলেনঃ আমি আল্লাহর রাসূলকেই চাই।’ সবার আগেই তিনি এ সিদ্ধান্ত দেন এবং রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরোধ করে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার এ সিদ্ধান্তের জন্য আপনি অন্য কাউকে বলবেন না।
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক সময় ‘আয়িশার (রা) রানের উপর মাথা রেখে শুয়ে যেতেন। একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় আবু বকর (রা) কোন এক কারণে মেয়ের উপর উত্তোজিত হয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েন এবং তাঁর পার্শ্বদেশে ধাক্কা দেন। কিন্তু ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরামের ব্যাঘাত হতে পারে, তাই মোটেই নড়াচড়া করলেন না।
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সকল বস্ত্রে ইনতিকাল করেন, ‘আয়িশা (রা) অতি যত্মের সাথে তা সংরক্ষন করেন। একবার এক সাহাবীকে তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি চাদর ও কম্বল দেখিয়ে বলেন, এই কাপড়ে তিনি ইনতিকাল করেন।
রাসূরে কারীমের গোটা জিন্দেগী মানবজাতির জন্য আদর্শ। এ কারণে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে খুশী করার জন্য কেমন আচরণ করবে, আমরা তাও ‘আয়িশা (রা) ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনে দেখতে পাই। আমরা কখনো কখনো রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) সাথে দারুণ উদার ও খোলামেলা দেখতে পাই। ‘আয়িশার (রা) অতি তুচ্ছ কোন তামাশা বা খেলাধুলা দেখেও তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আনসারী মেয়েকে প্রতিপালন করেন। খুব সাদামাটা ঘরে এসে বললেনঃ ‘আয়িশা! কোন গান-গীত তো নেই।
একবার ঈদের দিন কিছু হাবশী লোক নিযা হেলিয়ে দুলিয়ে পালোয়ানীর কসরত দেখাচ্ছিল। ‘আয়িশা (রা) স্বামীর নিকট এই খেলা দেখার আবদার করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং ‘আয়িশা (রা) সেই খেলা উপভোগ করলেন। যতক্ষণ ‘আয়িশা (রা) ক্লান্ত হয়ে নিজেই সরে না গেলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
একবার ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে একটু উঁচু গলায় কথা বলছিলেন। এমন সময় পিতা আবু বকর (রা) এসে উপস্থিত হলেন। তিনি মেয়ের এমন বেয়াদবী দেখে রেগে গেলেন এবং মারার জন্য হাত উঁচু করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্রুত মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে ‘আয়িশাকে রক্ষা করলেন। আবু বকর (রা) সরে গেলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশাকে বললেনঃ দেখলেতো, আমি তোমাকে কিভাবে বাঁচালাম?
একবার একটি মেয়েকে সঙ্গে করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) নিকট এসে বললেন, তুমি এই মেয়েটিকে চেন? আয়িশা (রা) বললেনঃ না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সে অমুকের দাসী। তুমি কি তার গান শুনতে চাও? ‘আয়িশা (রা) শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। দাসীটি দীর্ঘক্ষণ গান গাইলো। এক সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সম্পর্কে মন্তব্য করলেনঃ শয়তান তার নাকের ছিদ্রে বাদ্য বাজায়। অর্থাৎ এ ধরনের গান রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপছন্দ করেন। ‘আয়িশাকে (রা) খুশি করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাঝে মধ্যে তাঁকে গল্পও শোনাতেন। আবার কখনো কখনো ধৈর্যসহকারে ‘আয়িশার (রা) গল্পও শুনতেন। কিন্তু এমন ঘনিষ্ঠ ও আনন্দঘন মুহূর্তেও যদি আজানের ধ্বনি কানে আসতো, তিনি তখনি সোজা বেরিয়ে যেতেন, যেন কাকেও চেনের না।
একবার এক সফরে ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গি ছিলেন। চলার পথে এক পর্যায়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল সঙ্গীকে আগে চলার নির্দেশ দিলেন। তারপর ‘আয়িশাকে বললেনঃ এসো, আমরা দৌড়াই। দেখি কে আগে যেতে পারে। ‘আয়িশা (রা) ছিলেন হালকা পাতলা। তাই তিনি আগে চলে যান। তার কিছুকাল পরে এমন দৌড় প্রতিযোগিতার সুযোগ আরেকবার আসে। ‘আয়িশা (রা) বলেন, তখন আমি মোটা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার আগে চলে যান। তখন তিনি বলেনঃ এ হচ্ছে ঐ দিনের বদলা।
রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) সাথে যখন পানাহারে সুযোগ হতো তখন একই দস্তরখানে এক থালায় আহার করতেন। একবার পর্দার হুকুমের আগে তাঁরা এক সাথে আহার করছেন, এমন সময় ‘উমার (রা) এসে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে খেতে ডাকলেন এবং তিনজন এক সাথে খেলেন। পানাহারের মধ্যে প্রেম-প্রীতির অবস্থা এমন ছিল যে, ‘আয়িশার (রা) যেখানে মুখ লাগাতেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঠিক সেখানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন। রাতে যেহেতু ঘরে বাতি জ্বালতো না, তাই অন্ধকারে খেতে বসে মাঝে মাঝে উভয়ের হাত একই টুকরোর উপর গিয়ে পড়তো।
সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আয়িশার (রা) প্রেম-প্রিতিও মান-অভিমানের এক চমৎকার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ইসলাম যে মানুষের স্বাভাবগত নির্মল আবেগ-অনুভূতিকে অস্বীকার করেনি তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁদের আচরণের মধ্যে। কখনো কখনো তাঁদেরকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের মত আবেগপ্রবণ। আমাদের ভূলে গেলে চলবে না যে, ‘আয়িশা (রা) যেমন একজন নবীর স্ত্রী, তেমনি একজন নারীও বটে। আবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন একজন নবী ও রাসূর তেমনি একজন স্বামীও বটে সুতরাং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাঁদের এমন বহু আচরণ ও মান-অভিমানের কথা ও ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যা অতি চমকপ্রদ ও শিক্ষাণীয়।
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরলোকগত প্রথমা স্ত্রী খাদীজাকে (রা) প্রায়ই স্মরণ করতেন। একবার তিনি খাদীজার (রা) কথা আলোচনা করছেন, ‘আয়িশা (রা) বলে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এই বৃদ্ধার কথা এত স্মরণ করেন কেন। আল্লাহ তো আপনাকে তাঁর চেয়ে ভালো স্ত্রী দান করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ আমাকে তাঁর থেকে সন্তান দান করেছেন।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন খাদীজার (রা) প্রশংসা শুরু করলেন এবং দীর্ঘক্ষণ প্রশংসা করতে থাকলেন। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ এতে আমার অন্তর্দাহ হলো। বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি একজন কুরাইশ বৃদ্ধা, যার ঠোঁট লাল এবং যার মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়েছে, এত দীর্ঘ সময় তার প্রশংসা করছেন। আল্লাহ তো তাঁর চেয়ে ভাল স্ত্রী দান করেছেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারার রং পাল্টে গেল। তিনি বললেনঃ খাদীজা আমার এমন স্ত্রী ছিল যে, মানুষ যখন আমাকে নবী বলে মানতে অস্বীকার করে তখন সে আমার প্রতি ঈমান আনে, মানুষ যখন আমাকে সাহায্য করতে চায়নি তখন সে তার অর্থ-বিত্ত সহকারে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ তার মাধ্যমেই আমাকে সন্তান দিয়েছেন। যখন অন্য স্ত্রীরা আমাকে সন্তান থেকে রঞ্চিত করেছে।
একবার ‘আয়িশার (রা) মাথায় ব্যথা হলো। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন অন্তিম রোগলক্ষণ শুরু হতে চলেছে। তিনি ‘আয়িশাকে (রা) বললেনঃ তুমি যদি আমার সামনে মারা যেতে, আমি নিজ হাতে তোমাকে গোসল দিয়ে কাফন পরাতাম এবং তোমার জন্য দু’আ করতাম। আয়িশা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার মরণ কামনা করছেন। যদি এমন হয় তাহলে আপনি তো এই ঘরে নতুন একজন স্ত্রীকে এনে উঠাবেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কথা শুনে মৃদু হেসে দেন।
‘ইফক’ বা চরিত্রে কলস্ক আরোপের ঘটনার পর যখন ওহী দ্বারা ‘আয়িশার (রা) পবিত্রতা ঘোষিত হয় তখন তাঁর মা বললেনঃ যাও, স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। ‘আয়িশা (রা) ত্বরিৎ অভিমানের সুরে জবাব দিলেনঃ আমি এক আল্লাহ ছাড়া-যিনি আমার পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন, আর কারো প্রতি কৃতজ্ঞ নই।
একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘আয়িশা! তুমি আমার প্রতি কখন খুশী বা অখুশী থাক, আমি তা বুঝতে পারি। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ কিভাবে? বললেনঃ অখুশি থাকলে কসম খাও ‘ইবরাহীমের আল্লাহর কসম’ বলে, আর খুশী থাকলে বলঃ ‘মুহাম্মাদের আল্লাহর কসম।----==----
# == # স্বামীর সেবা
হাদীসের গ্রন্থাবলীর বিভিন্ন স্থানে ‘আয়িশার (রা) স্বামী-সেবার কথা ছড়িয়ে আছে। এখানে আমরা তার থেকে কিছু তুলে ধরছি। ঘরে খাদেম থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে সব কাজ করতেন। নিজ হাতে আটা পিষতেন, খাবার তৈরি করতেন, বিছানা পারতেন, ওযুর পানি এসে রাখতেন, স্বামীর কুরবারীন পশুর গলার রশি পাকাতেন, স্বামীর মাথায় চিরুনী করে দিতেন, দেহে আতর লাগিয়ে দিতেন, কাপড় ধুতেন, রাতে শোয়ার সময় মিসওয়াক ও পানি মাথার কাছে এনে রাখতেন, মিসওয়াক ধুয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে মসজিদে যান। একজন সাহাবী বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! কম্বলে তো কোন ময়লার দাগ দেখা যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি কম্বরটি খুলে একজন খাদেমের হাতে ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দেন। আয়িশা (রা) পানি আনিয়ে নিজ হাতে কম্বলটি ধুয়ে, শুকিয়ে আবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট পাঠিয়ে দেন।
কায়স আল-গিফারী (রা) ছিলেন আসহাবে সুফফার অন্যতম সদস্য। তিনি বর্ণনা করেছেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা সবাই আজ ‘আয়িশার ঘরে চলো। তিনি আমাদের সঙ্গে করে ঘরে গিয়ে বললেনঃ ‘আয়িশা! আমাদের সকলকে আহার করাও। আয়িশা (রা) আমাদের সকলকে পাকানো খাবার খাওয়ালেন এবং দুধ ও পানি পান করালেন। সম্ভবত এটা হিজাবের হুকম নাযিলের আগের ঘটনা।
‘আয়িশা (রা) স্বামীর প্রিয়তমা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অতি আগ্রহ ভরে অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় স্বামীর সেবা করতেন। স্বামীর আরাম-আয়েশ ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সর্বদা সজাগ থাকতেন। বার বার স্বামীর মিসওয়াকটি ধোয়ার প্রয়োজন পড়তো। এই কাজটির সুযোগ একক ভাবে ‘আয়িশা (রা) লাভ করতেন।----==----
# == # স্বামীর আনুগত্য ও অনুসরণঃ
ইসলামে স্ত্রীর অন্যতম গুণ হলো স্বামীর আনুগত্য ও অনুসরণ করা। ‘আয়িশা (রা) স্বামী সাহচর্যের দীর্ঘ নয় বছরে তাঁর কোন নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ বা অমান্য করা তো দূরের কথা,ইশারা-ইঙ্গিতেও যদি তিনি কোন অপছন্দের কথা বুঝিয়েছেন, তাও ‘আয়িশা (রা) সাথে সাথে পরিহার করেছেন। একবার তিনি অতি যত্ম সহকারে দরজায় একটি ছবিওয়ালা পর্দা টানালেন। রাসূর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে ঢুকতে যাবেন, এমন সময় পর্দার প্রতি দৃষ্টি পড়লো। সাথে সাথে তাঁর চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে ‘আয়িশা (রা) সবকিছু বুঝে ফেললেন। তিনি বললেনঃ আমায় ক্ষমা করুন! আমার অপরাধ কোথায় বলবেন কি? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ যে ঘরে ছবি থাকে সেখানে ফিরিশতা প্রবেশ করে না। একথা শোনার পর ‘আয়িশা (রা) পর্দাটি ছিঁড়ে ফেললেন।
স্বামীর জীবদ্দশায় বহু স্ত্রীই স্বামীর পূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর আয়িশা (রা) যে পরিমাণ স্বামীর আনুগত্য এবং হুকুম তামীর করেছেন, তার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকারের পর তিনি দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে স্বামীর প্রতিটি আদেশ ও ইচ্ছা তেমনিভাবে পালন ও পূরণ করেছেন যেমন তাঁর জীবনকালে করতেন।
রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশা (রা) দানশীলতা শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমরণ তিনি এ গুণটি অতি নিষ্ঠার সাথে ধারণ করে থাকেন। একবার তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট জিহাদের অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ নারীদের জিহাদ হলো হজ্জ। এই বাণী শোনার পর থেকে এমন কঠোরতার সাথে আমল করতে থাকেন যে, তাঁর জীবনের খুব কম বছরই হজ্জ ছাড়া অতিবাহিত করেছে।১৩২
একবার এক ব্যক্তি কিছু কাপড় ও কিছু নগর অর্থ ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠালো। তিনি প্রথমে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফেরত পাঠালেন। তারপর আবার লোকটিকে ডেকে এনে তা গ্রহণ করেন এবং বললেনঃ আমার একটি কথা মনে এসে গেল।
একবার ‘আরাফাতের দিন ‘আয়িশা (রা) রোযা রাখলেন। প্রচন্ড গরমের কারণে মাথায় পানির ছিটা দিচ্ছিলেন। একজন রোযা ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেনঃ আমি যখন রাসূরুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে শুনেছি যে, আরাফাতের দিন রোযা রাখলে সারা বছরের পাপ মোচন হয়ে যায়,তখন তা কিভাবে ভাংতে পারি?
রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাশতের নামায পড়তে দেখে সারা জীবন তিনি এই নামায পড়েছেন। তিনি বলতেনঃ আমার পিতাও যদি কবর থেকে উঠে এসে আমাকে এ নামায পড়তে নিষেধ করেন, আমি তাঁর কথা মানবো না। একবার এক মহিলা ‘আয়িশাকে (রা) জিজ্ঞেস করলোঃ মেহেদী লাগানো কেমন? জবাব দিলেনঃ আমার প্রিয়তমের মেহেদীর রং খুব পছন্দ ছিল, তবে গন্ধ পছন্দ ছিল না। হারাম নয়। ইচ্ছা হলে তুমি লাগাতে পার।----==----
# == # গৃহ অভ্যন্তরে স্বামী-স্ত্রীর দীনী জীবন
‘আয়িশার (রা) ঘরটি ছির একজননবীর আবাসস্থল। সেখানে বিত্ত-বৈভবের কোন ছোঁয়া ছির না। পার্থিত ঐশ্বর্যের প্রতি তাঁদের কোন পরোয়াও ছিল না। ‘আয়িশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভ্যাস ছির যখন ঘরে আসতেন, একটু উঁচু গলায় নিম্নের কথাগুলি বার বার উচ্চারণ করতেন।
‘আদম সন্তানদের মালিকানায় যদি ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ দুইটি উপত্যকা হয়, তাহলে সে তৃতীয়টির লোভ করবে। তার লোভের মুখ শুধুমাত্র মাটিই ভরতে পারে। আল্লাহ বলেন, ধন-সম্পদ তো আমি নামায কায়েম এবং যাকাত দানের জন্য সৃষ্টি করেছি। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, আল্লাহও তার দিকে ফিরে আসেন।’
মানুষের লোভের যে কোন শেষ নেই, এবং ধন-সম্পদ দানের মূল উদ্দেশ্য কি, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই ছিল তার আসল লক্ষ্য।
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘ঈশার নামায আদায়ের পর ঘরে আসতেন। মিসওয়াক করে সাথে সাথে শস্যা নিতেন। মাঝ রাতে জেগে তাজাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। রাতে শেষভাবে ‘আয়িশাকে (রা) জাগিয়ে দিতেন। তিনি উঠে স্বামীর সাথে নামাযে অংশগ্রহণ করতেন। সবশেষে বিতর নামায আদায় করতেন। সুবহে সাদিক হওয়ার পর রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের সুন্নাত আদায় করে কাত হয়ে একটু শুয়ে যেতেন এবং ‘আয়িশার (রা) সাথে কিছু কথা-বার্তা বলতেন।১৩৭ তারপর ফজরের ফরয আদায়ের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হতেন। কখনো কখনো সারা রাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ‘আয়িশা (রা) আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগীতে কাটিয়ে দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমাম হতেন, ‘আয়িশা (রা) হতেন মুক্তাদী। কুসূফ ও খুসূক (সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ) এর অবস্থায় রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায়ের দাঁড়ালে তিনিও দাঁড়িয়ে যেতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে জামা’য়াতের ইমামতি করতেন, আর তিনি ঘরে ইকতিদা করতেন।
পাঞ্চেগানা নামায ও তাহাজ্জুদ ছাড়াও রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখে তিনি চাশতের নামাযও নিয়মিত পড়তেন। প্রায়ই রোযা রাখতেন। মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এক সাথে রোযা পালন করতেন। রমযানের শেষ দশদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মকজিদে ইতিকাফ করতেন। ‘আয়িশাও (রা) এতে শরিক হতেন। মসজিদের আঙ্গিনায় তাঁবু টানিয়ে ঘিরে নিতেন। ফজর নাযমাযের পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু সময়ের জন্য সেখানে আসতেন।
হিজরী ১১ সনে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের সফরসঙ্গী হন। হজ্জ ও উমরার নিয়েত কনের। কিন্তু স্বাভাবিক নারী প্রকৃতির কারণে যথাসময়ে তাওয়াফ করতে পাররেন না। দারুণ কষ্ট পেলেন। কাঁদতে শুরু কররেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহির থেকে এসে কাঁদতে দেখে কাঁদতে শুরু কররেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহির থেকে এসে কাঁচতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস কররেন এবং তাঁকে করণীয় মাসয়ারা বাতলে দিলেন। তিনি ভাই ‘আবদুর রহমান ইবন আবী বকরকে (রা) সাথে নিয়ে অসমাপ্ত আবশ্যকীয় কাজ সমাপন করলেন।১৪০
আমাদের মত সাধারণ মানুষ মনে এমন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি গৃহ অব্যন্তরে আরাম ও বিম্রামের সময় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে একটু শিথিলতা (নাউজুবিল্লাহ) দেখাতেন? এমন ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। পূর্বেই আমরা ‘আয়িশার (রা) মন্তব্য উল্লেখ করেছি-‘রাসূর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সাথে কথা বলতেন। আজানের ধ্বনি কানে যেতেই উঠে দাঁড়াতেন। তখন মনে হতো তিনি যেন আমাদের চেনেনই না।’ ‘আয়িশা (রা) খুব সাধ করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুশী করার জন্য ছবিওয়ালা পর্দা টানালেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্তুটির পরিবর্তে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
একবার ‘আয়িশা (রা) এক ইহুদীকে-যে তাঁকে মৃত্যুর অভিশাপ দিয়েছিল, কঠোর ভাষায় প্রত্যুত্তর করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাথে বরেনঃ আয়িশা! আল্লাহ অতি দয়াবান। তিনি দয়া ও কোমলতা পছন্দ করেন। আর একবার আয়িশা (রা) নিজ হাতে আটা পিষে রুটি বাণিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। এই সুযোগে প্রতিবেশীর একটি ছাগল ঘরে ঢুকে সব খেয়ে ফেলে। ‘আয়িশা (রা) দৌড়ে ছাগলটি ধরে কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে গেলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাধা দিয়ে বললেনঃ ‘আয়িশা! প্রতিববেশীকে কষ্ট দিও না।----==----
# == # সতীন ও তাদের সন্তানদের সাথে সম্পর্কঃ
আমাদের জানা মতে এ পৃথিবীতে একজন নারীর সবচেয়ে অসহনীয় বিষয় হলো সতীনের অস্তিত্ব। ‘আয়িশার (রা) এক সাথে সতীন ছিলেন একজন থেকে নিয়ে আটজন পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান সাহচর্যের দৌলতে তাঁরেদ সকলের দৃহয়ের যাবতীয় আবিলতা দূর হয়ে তা স্বচ্ছ আননায় পরিণত হয়। সতীন ও তাঁদের সন্তান-সন্তুতিদের সাথে ‘আয়িশার (রা) জীবন যাপনের যে চিত্র আমরা পাই তা বিশ্বের নারী জাতির জন্য এক অতুলনীয় আদর্শ হয়ে আছে।
খাদীজা (রা) যদিও ‘আয়িশার (রা) সময়ে বেঁচে ছিলেন না, তবে রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হৃদয় মাঝে তিনি সর্বদা জীবিত ছিলেন। তনি ‘আয়িশার (রা) কাছে সবসময় খাদীজার (রা) স্মৃতিচারণ করতেন। এ কারণে ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ ‘আমি যে পরিমাণ খাদীজাকে ঈর্ষা করতাম না। আর তা এই জন্য যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে খুব বেশি স্মারণ করতেন, অন্য কেউ তা করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক খাদীজার (রা) নামে কুরবানী করা, খাদীজার বান্ধবীদের নিকট হাদীয়া-তোহফা পাঠানো, ইসলামের প্রথম পর্বে তাঁর যাবতীয় অবদান, যথাঃ স্বামীকে সান্ত্বনা ও ধৈর্য ধারণের উপদেরশ দান, যাবতীয় উপায়-উপকরণ দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি কর্মকান্ডের কথা কিন্তু আয়িশাই (রা) এই উম্মাতকে জানিয়েছেন। আল্লাহ পাক যে, খাদীজাকে (রা) জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, সে কথাটিও তিনি জানিয়েছেন।১৪১ এতেই তাঁর হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও প্রশস্ততার কথা অনুমান করা যায়।
সাওদার (রা) প্রশংসার ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ ‘একমাত্র সাওদা ছাড়া অন্য কোন নারীকে দেখে আমার মধ্যে এমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি যে, তাঁর দেহে যদি আমার প্রাণটি হতো।’ মায়মূনার (রা) মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরহেযগার ছিলেন।’১৪২ সাফিং্যা (রা) চমৎকার খাবার তৈরি করতে পারতেন। তাঁর এই পারদর্শিতা তিনি স্বীকার করেন এইভাবে আমি তাঁর চেয়ে ভালো খাবার তৈরি করতে পারে এমন কাউকে দেখিনি।’ সতীনদের সাথে তাঁর উঠা-সবা ও আচার-আচরণের অনেক কথা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে বিদ্যামান আছে-যাতে তাঁর উদারতা, মহানুভবতা ও উন্নত নৈতিকতার চিত্র ফুঠে উঠেছে। ‘আয়িশার (রা) মধুর ব্যবহার ও আচারণ সকলকে খুশী করেছিল। আর তাই ‘ইফক (কলস্কা আরোপ) এর ঘটনার সময়-যখন তাঁর দিশেহারা অবস্থা, তখন তাঁর অন্যতম সতীন যয়নাবকে (রা) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাব দিয়েছিলেনঃ আমি তো তাঁর মধ্যে শুধু ভালো ছাড়া কিছু জানিনে।’১৪৩
‘আয়িশা (রা) নিঃসন্তান ছিলেন। তবে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য স্ত্রীদের বেশ কয়েকজন সন্তান ছিলেন। তাঁদের সাথে ‘আয়িশার (রা) সম্পর্ক ছিল আদর্শ মানের। যয়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মু কুলসুম ও ফাতিমা-এই চার কন্যা ছিলেন খাদীজার (রা) সন্তান। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে আসার পূর্বে একমাত্র ফাতিমা (রা) ছাড়া অন্যদের বিয়ে হয়ে যায় এবং সবাই নিজ নিজ স্বামীর ঘরে চরে যান। হিজরী ৬ষ্ঠ সনে রুকাইয়্যা এবং হিঃ ৮ম ও ৯ম সনে যথাক্রমে যয়নাব ও উম্মু কুলসুম ইনতিকাল করেন। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে তাঁদের সাথে ‘আয়িশার (রা) তিক্ত সম্পর্কের একটি ঘটনাও পাওয়া যায় ন। বরং এ সকল কন্যা সম্পর্কে ১আয়িশার (রা) যে সব মন্তব্য ও আচারণের কথা পাওয়া যায় তাতে তাঁদের; সাথে তাঁর গভীর হৃদ্যতার কথা জানা যায়। যয়নাব, যিনি আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করেন, তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বাণীটি ‘আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ সে আমার অতি ভালো মেয়ে ছিল, আমাকে ভালোবাসার কারণে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে।’ এই যয়নাবের মেয়ে উমামাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী পরিমাণ স্নেহ ও আদর করতেন তা ‘আয়িশাই (রা) বর্ণনা করেছেন।
‘আয়িশা (রা) যখন স্বামীগৃহে আসেন তখন কুমারী মেয়ে ফাতিমা (রা) পিতার ঘরে। কিন্তু তিনি বয়সে ‘আয়িশার চেয়ে পাঁচ বছর অতবা ছয় বছরের বড়। এক বছর বা তার চেয়ে কিছু কম সময়ের জন্য এই মা-মেয়ে এক সাথে কাটান। হিজরী ২য় সনের মধ্যে আলীর (রা) সাথে এই মেয়ের বিয়ে হয়। এই বিয়ের উদ্যোগ আয়োজনে অন্য মা-দের সাথে ‘আয়িশার (রা) শরিক ছিলেন। মুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশে তিনি বিশেষ গুরুত্বও প্রদান করেন। ঘর লেপেন, বিছানা তৈরি করেন, নিজের হাতে খেজুরের ছাল দুনে বালিশ বানান, খেজুর ও মানাক্কা অতিথিদের সামনে পেশ করেন এবং কাঠের একটি আলনার মত তৈরি করেন পানির মশক ও কাপড় চোপড় টানোনোর জন্য। ‘আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ ‘ফাতিমার বিয়ের মত এত চমৎকার বিয়ে আর দেখিনি।
ফাতিমার (রা) প্রশংসায় ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ আমি ফাতিমার চেয়ে একমাত্র তার পিতা ছাড়া আর কোন ভালো মানুষ কক্ষণো দেখিনি। একবার এক তারে’ঈ আয়িশাকে (রা) প্রশ্ন করলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে প্রিয় কে ছিলেন? উত্তর দিলেনঃ ফাতিমা। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মত চান-চলন, উঠা-সবায় মিলে যায় একমাত্র ফামিতা ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। ফাতিমা যখন তাঁর পিতার সাথে দেখা করতে আসতেন পিতা সোজা দাঁড়িয়ে যেতেন। মেয়ের কপারে চুমু খেতেন এবং নিজের স্থানে বসাতেন। আবার পিতা তার ঘরে গেলে মেয়ে উঠে দাঁড়াতেন, পিতাকে চুমু দিতেন এবং জিনের স্থানে নিয়ে বসাতেন।
স্বামীগৃহে ফাতিমা (রা) নিজ হাতে যাবতীয় কাজ করতে করতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। একদিন পিতার কাছে এসেছিলেন একটি দাসী প্রাপ্তির আবেদন নিয়ে। ঘটনাক্রমে পিতার দেখা পেলেন না। মা ‘আয়িশাকে এ ব্যাপারে কথা বলার দায়িত্ব দিলে তিনি ফিরে গেলেন।
আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন। ‘‘একদিন আমরা সকল স্ত্রী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে বসে আছি। এমন সময় ফাতিমা সামনের দিক থেআেসলো। তার চলন ছিল বিকল রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মত, একটুও পার্থক্য ছিল না রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত আবেগের সাথে তাকে ডেকে পাশে বসালেন। তারপর চুপে চুপে তার কানে কিছু কথা বললেন। ফাতিমা কাঁদতে লাগলো। তার অস্থিরতা দেখে রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে কাকে আবার কিছু বললেন। এবার ফাতিমা হাসতে লাগলো। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ আমি বললামঃ ফাতিমা! রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের বাদ দিয়ে তোমার কাছে গোপন কথা বলেন, আর তুমি কাঁদছো? রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উঠে গেলে আমি ফাতিমার নিকট বিষয়টি জানতেচাইলাম। সে বললোঃ আমি আমার আববার গোপন কথা ফাঁস করবো না।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর ‘আয়িশা (রা) আবার একদিন বিষয়টি জানতে চান। ফাতিমা বলেন, আমার কান্নার কারণ হলো, তিনি আমাকে তাঁর মৃত্যুর কথা বলেছিলেন। হাসির কারণ হলো, তিনি আমাকে বলেনঃ ফাতিমা! এ কি তোমার পছন্দ নয় যে, তুমি সারা পৃথিবীর নারীদের নেত্রী হও?’
উপরে উল্লেখিত এ সকল ঘটনা দ্বারা ‘আয়িশার (রা) সাথে তাঁর সতীন-কন্যাদের কেমন মধুর সম্পর্ক ছিল তা বুঝা যায়। এ ধরনের আরো বহু ঘটনা হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান।----==----
# == # যুদ্ধ-বিগ্রহ
ইমাম বুখারী বর্ণণা করেছেন। আনাস (রা) উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ আমি ‘আয়িশা ও উম্মু সুলাইমকে (রা) দেখলাম, তাঁরা কাঁধে করে মশক ভরে পানি এনে আহতদের মুখে ঢালছেন। পানি শেষ হয়ে গেলে আবার ভরে এনে ঢালছেন।১৪৮ উহুদ যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স দশ এগারো বছরের বেশি হবেনা। এই যুদ্ধে তিনি যোগদান করে আহতদের সেবা করেছেন।
ইমাম বুখারী বলেন, বনু মুসতালিক যুদ্ধই হলো আল-মুরাইসী ‘যুদ্ধ। এই যুদ্ধটি কোন্ সনে হয় সে সম্পর্কে অবশ্য সীরাত বিশেষজ্ঞদের একটু মতভেদ আছে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, এটি হয় ষষ্ঠ হিজরীতে। মূসা ইবন ‘উকবা বলেন চতুর্থ হিজরীতে, আর ‘উরওয়া বলেন, এটা পঞ্চম হিজরীর শা‘বান মাসের ঘটনা।১৪৯ আল-মুরাইসী হলো বনু মুসতালিক গোত্রের একটি ঝর্ণা। তাদের নেতা ছিল আল-হারেস ইবন আবী দারবার। সে তার নিজ গোত্র ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গোত্রের লোকদের রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সংগঠিত করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ খবর অবগত হয়ে তাদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে একটি বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন। এই বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক মুনাফিক (কপট মুসলমান) অংশগ্রহণ করে যা অন্য কোন যুদ্ধে কখনো করেনি।১৫০ অবশেষে আল-মুরাইসী‘-এর পাশে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। এই অভিযানে মুনাফিকরা হযরত ‘আয়িশাকে (রা) নিয়ে একটি কুৎসিত ষড়যন্ত্র পাকায় ঘটনাটি আরো একটু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছি।
হিজরী ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ সনের শা‘বান মাসে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে পারলেন যে, মুরাইসী ‘এর পাশে বসবাসকারী লোকেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে। এ কথা জানার পরপরই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে এই লোকদের দিকে যাত্রা করলেন। মুনাফিক-শ্রেষ্ঠ ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই বিপুল সংখ্যক মুনাফিক সকেঙ্গ নিয়ে এই যাত্রায় নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঙ্গে শরিক হলো। ইবন সা‘দ বলেন, ইতিপূর্বে কোন যুদ্ধেই এত সংখ্যক মুনাফিক যোগদান করেনি। অভিযান শেষে এমিুনাফিকরা নানাভাবে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। আল্লাহ পাকের রহমত ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দূরদৃষ্টি ও সুযোগ্য নেতৃত্বে ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাইয়ের সকল চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এই সফরেই তারা উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশাকে (রা) কেন্দ্র করে এক ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা হযরত ‘আয়িশার (রা) পবিত্র চরিত্রের উপর এক চরম অপমানকর মিথ্যা দোষারোপ করে বসে। মূল কাহিনীটি হযরত ‘আয়িশার (রা) ভাষায় সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ
রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ম লিছ যখন দূরে কোথাও বের হতেন, কুর‘আ‘র মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁর স্ত্রীদের মধ্রে কে তাঁর সঙ্গী হবেন। বনী আল মুসতালিক যুদ্ধের সময় কুর‘আ‘য় আমার নামটি আসে। ফটে আমি তাঁর সফর সঙ্গী হই। ফিরে আসার সময় যখন আমরা মদীনার কাছাকাছি পৌছি, রাতের বেলা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক মানযিরে তাঁবু গেড়ে অবস্থান কনের। রাতের শেষভাবে সেখানে থেকে যাত্রার প্রস্ত্ততি শুরু করা হয়। আমি ঘুম থেকে জেগে সআবভাবিক প্রয়োজন সারার জন্য বাইরে গেলাম। ফিরে আসার সময় অবস্থানের কাছাকাছি স্থানে আসতেই মনে হলো যে, আমার গলার হারটি কোথাও পড়ে গেছে। আতি তা খুজতে রেগে গেলাম। ইতিমধ্যে কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেছে। নিয়ম ছিল যে, রওয়ানা হওয়ার সময় আমি আমার ‘হাওদাজে’ (উঠের পিঠের পালকি) বসে যেতাম, তাপর চারজন লোক তা তুলে উটের পিঠের উপর বেঁধে দিত। এই সময় অভাব অনটনের কারণ আমরা মেয়েরা ছিরাম বড়ই হালকা-পাতলা। আমার ‘হাওদাজ’ উঠানোর সময় লোকেরা টেরই পেলনা যে, আমি ওর মধ্যে নেই। অজ্ঞাসতারে তারা হাওদাজ উটের পিঠে বসিয়ে রওয়ানা হলে গেল।
এদিকে আমি হার খুঁজে পেলাম এবং ফিরে এসে সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম ন। ফলে আমি আমার গায়ের দাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে সেখানেই পড়ে থাকলাম। চিন্তা করলাম, সামনে গিয়ে যখন আমাকে দেখতে পাবে না, তখন তারা আমার তালাশে ফিরে আসবে। এই অবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা সাফওয়ান ইবন মু‘য়াত্তাল আল-সুলামী সেখানে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সেখানে উপস্থিত হলেন। আমাকে দেখেই তিনি চিনতে পারলেন। কারণ পর্দার নির্দেশ নাযিল হওয়ার আগে তিনি আমাকে কয়েকবার দেখিছিলেন। আমাকে দেখে তিনি উট থামালে এবং বিষ্শয়ের সাথে তাঁর মুখে উচ্চারিত হলো-ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন! রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগম সাহেবা এখানে রয়ে গেছেন।
তাঁর কণ্ঠস্বর কানে যেতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম এবং চাদর দ্বারা মুখ ঢেকে ফেলরাম। তিনি আমার সঙ্গে কোন কথাই বললেন না। নিজের উটটি এনে আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। আমি উঠের পিঠে উঠে বসলাম, আর তিনি লাগাম ধরে হেঁটে চললেন। প্রায় দুপুরের সময় আমরা কাফেলাকে ধরলাম-যখন তারা এক স্থানে সবেমাত্র থেমেছে। আর আমি যে পিছনে রয়ে গেছি, সে কথা তাদের কেউ জানতেও পারেনি। এই ঘটনার উপর মিথ্রা দোষারোপের এক পাহাড় রচনা করা হরো। যারা এই ব্যাপারে অগ্রণী ছিল, তাদের মধ্রে ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই ছির সবার চেয়োগ্রসর। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে কি কি কথা বরা হচ্ছে, আমি তার কিভুই জানতে পারিনি।’
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, সাফওয়ানের উটের পিঠে সওয়ার হয়ে হযরত ‘আয়িশা (রা) যে সময় সৈনিকদের তাঁবুতে উপস্থিত হরেন এবং তিনি পিছনে পড়ে ছিলেন বলে জানা গেল, তখন ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই চিৎকার করে বলে উঠলোঃ ‘আল্লাহর কসম! এই মহিলাটি নিজেকে বাঁচিয়ে আসতে পারেনি। দেখ, দেখ, তোমাদের নবীর স্ত্রী অপরের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, আর এখন সে প্রকাশ্রভাবে তাকে সংগে নিয়ে চলে এসেছে।’
‘আয়িশা (রা) বলেন, ‘‘মদীনায় ফিরে আসার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রায় এক মাসকাল আমি শয্যাশায়ী হয়ে থাকলাম। শহরের সর্বত্র এই মিথ্যা দোষারোপের খরব উঠে বেড়াতে লাগলো। নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কান পর্যন্ত পৌঁছাতে দেরী হলো’ না। কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারলাম না। একটি খটকা অবশ্র আমার মনে লাগছিলো। তা হলো, অসুস্থ অবস্থায রাসূরে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে রকম লক্ষ্র দিতেন, এবার তিনি তেমন দিচ্ছেন না। তিনি ঘরে এল ঘরের লোকদেরকে শুধু জিজ্ঞেস করতেনঃ ‘ও কেমন আছে’? আমার সংগে কোন কথা বলতেন না। এতে আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল, কোন কিছু ঘটেছে হয়তো। শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আমি আমার মায়ের নিকট চরে গেলাম। যাতে মা আমার সেবা-শুশ্রুষা ভালোভাবে করতে পারেন।
একদিন রাতের বেলা প্রকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে গেলাম। তখনও পর্যন্ত আমাদের সব বাড়ীতে পায়খানা নির্মিত হয়নি। আমরা প্রাকৃতিক প্রয়োজনের জন্য বনে-জঙ্গলেই যেতাম। আমার সংগে মিসতাহ ইবন উসাসা’র মাও ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার পিতার খালাতো বোন। তিনি পথ চরতে গিয়ে হোঁচট খান। তখন অকম্শাৎ তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়! ধ্বংস হোক মিসতাহ’। আমি বরলামঃ আপনি কেমন মা? নিজের ছেলের ধ্বংস কামনা কনের! আর ছেলেও এমন, যে বদর যুদ্ধে যোগদান করেছিল। তিনি বললেনঃ ‘‘মেয়ে! তুমি কি কোন খবরই রাখো না? তারপর তিনি আমাকে সকল কাহিনী বললেন। মিথ্রাবাদীরা আমার সম্পর্কে কি কি বলে বেড়াচ্ছিল, তা সবই শোনালে।’’
উল্লেখ্য যে, মুনাফিকীন ছাড়ও মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমান এই মিথ্যার অভিযানে শরিক হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্রে মিসতাহ ইবন উসাসা, ইসলামের প্রখ্যাত কবি হাসসান ইবন সাবিত ও হযরত যয়নাব (রা) এর বোন হামনা বিনত জাহাশ বিশেষ উল্লেকযোগ্য। ‘আয়িশা (রা) বলেনঃ এই কাহিনী শুনে আমার রক্ত যেন পানি হয়ে গেল। যে জন্য এসছিলাম, সেই প্রয়োজনের কথাও ভুলে গেলাম। সোজা ঘরে ফিরে গেলাম এবং সারা রাত কেঁদে কাটালাম।
এদিকে আমার অনুপস্থিতিকালে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আলীও উসামা ইবন যায়িদকে (রা) ডাকলেন এবং তাদের নিকট এই বষিয়ে পরামার্শ চাইলেন। উসামা (রা) আমার পক্ষে ভালো কথাই বললেন। বললেনঃ ইয়া রাসূলার্লাহ! আপনার স্ত্রীর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু কখনো দেখতে পাইনী। যা কিছু বলে বেড়ানো হচ্ছে, তা সবই মিথ্যা কথা, রচিত অভিযেগা মাত্র। আর ‘আলী বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের সমাজে মেয়ে লোকের কোন অভাব নেই। আপনি এর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। আর আসল ব্যাপার যদি জনতে চান, তাহলে দাসীকে ডেকে অবস্থা জেনে নিতে পারেন।
দাসীকে ডাকা হলো এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। সে বললোঃ ‘আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর মধ্যে খারাপ কিছুই দেখিনি-যে সম্পর্কে আপত্তি করা যেতে পারে। দোষ শুধু এতটুকুই দেখেছি যে, আমি আটা মেখে রেখে যেতাম, আর বরতাম, একটু দেখবেন। কিন্তু তিনি ঘুমেয় পড়তেন, আর তৈরি আটা ছাগর এসে খেয়ে যেত।’
সেইদিন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এক ভাষণে বললেনঃ ‘হে মুসলমানরা, তেমাদের মধ্যে এমন কে আছে-আমার স্ত্রীর উপর মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে-তার আক্রমণ হতে আমাকে বাঁচাতে পারে? আল্লাহর শপথ, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখতে পাইনি, না সেই লোকটির মধ্যে যার সম্পর্কে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে।ভ আমার অনুপস্থিতির সময় সে তো কখনই আমার ঘরে আসেনি।’ এই কথা শুনে হযরত উসাইদ ইবন হুদাইর, কোন কোনবণৃনা মতে হযরত সা’দ ইবন মু‘য়াজ (রা) দাঁড়িয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ। অভিযোগকারী যদি আমাদের বংশের লোক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তাকে হত্যা করবো। আর আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের লোক হলে আপনি যা বলবেন, তাই করবো।’ এই কথা শুনেই খাযরাজ গোত্র-প্রধান সা‘দ ইবন ‘উবাদা দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ ‘তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি কিছুতেই তাকে মারতে পারবে না। তুমি তাকে হত্যা করার কথা শুধু এই জন্য বলছো যে, সে খাযরাজ গোত্রের লোক। সে তোমাদের লোক হলে তুমি কখনই তাকে হত্যা করার কথা বলতে পারতে না।’ জবাবে তাকে বলা হয়েছিলঃ তুমি তো মুনাফিক, এই জন্য মুনাফিকদের সমর্থন দিচ্ছো।’
এই বাক-বিতন্ডায় মসজিদে নববীতে একটা হট্ট্রাগোলের সৃষ্টি হয়। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা মসজিদেই লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ঠান্ডা করেন এবং পরে মিন্বরের উপর হতে নেমে আসেন।
অন্তত একমাত্র কাল এই মিথ্যা দোষারোপের বানোয়াট কথা সমাজে উড়ে বেড়াতে লাগলো। নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কঠিন মানসিক কষ্ট পেতে থাকলেন। আমি কান্নাকাটি করতে লাগলাম। আমার পিতা-মাতা সীমাহীন দুশ্চিন্তায় ও উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিলেন। শেষ পযন্ত নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন আসলেন এবং আমার পাশে বসলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি একবারও আমার কাছে বসেননি। আবু বকর ও উম্মু রুমান (আয়িশার পিতা-মাতা) মনে করলেন, আজ হয়তো কোন সিদ্ধান্তমূলক কথা হয়ে যাবে। এই কারণে তাঁরাও নিকটে এসে বসলেন। নবী কারী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আয়িশা, তোমার সম্পর্কে এই সব কথা আমার কানে পৌঁছেছে। তুমি যদি নিষ্পাপ হয়ে থাক, তাহলে আশা করি আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা প্রকাশ ও প্রমাণ করে দেবেন। আর তুমি যদি বাস্তবিকই কোন প্রকার গুনাহে লিপ্ত হয়ে থাক, হাতলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর, ক্ষা চাও। বান্দাহ যখন গুনাহ স্বীকার করে, তাওবা করে,তখন আল্লাহ মা‘ফ করে দেন।
এই কথা মুনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেল। আমি পিতাকে বললাম, আপনি রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার জনাব দিন। তিনি বলরেনঃ মেয়ে! আমি কি বলবো তা বুঝতে পারছিনা।’ আমি আমার মাকে বললাম, আপনিই কিছু বলুন।: তিনি বললেনঃ আমি কি বলবো তা আমার বুঝে আসে না।’ তখন আমি বললামঃ আপনাদের কানে একটা কথা এসেছোমনি তা মনের মধ্যে বসে গেছে। এখন আমি যদি বলি, আমি নির্দোষ-আল্লাহ সাক্ষী, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ-তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি শুধু শুধুই এমনএকটা কথা স্বীকার করে নিই যা আমি আদৌ করিনি-আল্লাহ জানেন যে, আমি তখন হযরত ইয়াকুব (আ) এর নামটি স্বরণ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তা স্বরণে এলো না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, এমন অবস্থায় আমি সেই কথা বলা ছাড়া আর কোন উপায় দেখি না, যা হযরত ইউসুফ (আ) এর পিতা বলেছেনঃ
এই কথা বলে আমি অপরদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। আমি মনে মনে বললামঃ আল্লাহ আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। তিনি নিশ্চয়ই প্রকৃত ব্যাপার লোকদের সামনে উম্মোচিত করে দিবেন। তবে আমার সপক্ষে ‘ওহী’ নাযিল হবে, আর তা কিয়ামত পর্যন্ত পড়া হবে, এমন ধাণা আমার মনে কখনো আসেনি। আমি মনে করেছিলাম, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন স্বপ্ন দেখবেন, আর তাতে আল্লাহ আমার নির্দোষিতা প্রকাশ করে দিবেন। এরই মধ্রে নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর ‘ওহী’ নাযিল হওয়াকালীন অবস্থা সৃষ্টি হলো। এমনকি তীব্র শীতের মধ্যে তাঁর চেহারা মুবারক হতে ঘামের ফোটা টপ টপ করে পড়তে লাগলো। এমন অবস্থা দেখে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমি মনে মনে পূর্ণমাত্রায় নির্ভয় ছিরাম। কিন্তু আমার পিতা-মাতার অবস্থা ছিল বড়ই মর্মান্তিক। আল্লাহ কোন মহাসত্য উদঘাটন করেন, সেই চিন্তায় তারা ছিলেন অস্থির, উদ্বিগ্ন। ‘ওহী’ কালীন অবস্থা শেষ হয়ে গেলে রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুবই উৎফুল্ল দেখা গেল। তিনি হাসি সহকারে প্রথম যে কথাটি বললেন তা ছিল এইঃ ‘আয়িশা, তোমাকে সুসংবাদ। আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা ঘোষণা করে ওহী নাযিল করেছেন। অতঃপর তিনি সূরা আন-নূর-এর ১১ আয়াত থেকে ২১ নং আয়তা পর্যন্ত পাঠ করে শুনালেন। আমার মা তখন আমাকে বললেনঃ ‘ওঠা, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুকরিয়া আদায় কর।’ আমি বললামঃ আমি না উনার শুকরিয়া আদায় করবো, আর না আপনাদের দুইজনের। আমি তো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আমার নির্দোষিতা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত নাযিল করেছেন। আপনারা তো এই মিথ্যা অভিযোগকে অসত্য বলেও ঘোষনা করেন নি।১৫১
হযরত ‘আয়িশার (রা) বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিন করা হয়েছিল, আল-কুরআনের ভাষায় তাকে ‘আল-ইফক’ বলা হয়েছে। এই শব্দ দ্বারা স্বয়ং আর্লাহ তা‘আলার তরফ হতে এইাভিযোগের পরিপূর্ণ প্রতিবাদ করা হয়েছে। ‘ইফক’ শব্দের অর্থ মূল কথাকে উল্টিয়ে দেওয়া, প্রকৃত সত্যের বিপরীত যা ইচ্ছা বলে দেওয়া। এই অর্থের দৃষ্টিতে এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মনপড়া কথা-অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোন অভিযোগ সম্পর্কে শব্দটি প্রযোগ হলে তার অর্থ হয়, সুস্পষ্ট মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা দোষারোপ।
হযরত ‘আয়িশার (রা) নির্দোষিতা ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার পর সুষ্পষ্ঠভাবে মিথ্যা দোষারোপ করার অভিযোগে দুইজন পুরুষ ও একজন নারীর উপর ‘হদ’ (নির্ধারিত শাস্তি) জারি করা হয়। তাঁরা হলেনঃ মিসতাহ ইবন উসাসা, কবি হাসসান ইবন সাবিত ও হামনা বিনত জাহাশ (রা)।----==----
# == # তায়াম্মুমের আয়াত নযিলের ঘটনাঃ
আল্লাহ পাক হযরত ‘আয়িশাকে (রা) উপলক্ষকরে মানবজাতিকে বহুবিধ কল্যাণের থ দেখিয়েছেন। ‘ইফকূ কে কেন্দ্র করে মানব সমাজে যৌনাচার ও অশ্লীলতা থেকে পবিত্র রাখার জন্য অনেকগুলি বিধি বিষেধ ও দন্তবিধি গোষণা করেছেন। তেমনি পাক-পবিত্র হওয়ার জন্য পানির বিকল্প হিসেবে তায়াম্মুমের সুযোগও তাঁকেই কেন্দ্র করে দান করেছেন। এখানে সে সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা বলে মনে করি।
একবার আর এক সফরে ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংগে ছিলেন। ইবন সা‘দের মতে, এটাও ছির ‘আল-মুরাইসী’ যুদ্ধ-সফরের ঘটনা।১৫৪ সেই একই হার এবারও তাঁর গলায় ছিল। কাফেলা যখন ‘জাতুল জাইশ’ অথবা আল-বায়দা নামক স্থানে পৌঁছে, তখন হারটি গলা থেকে আবার ছিঁড়ে কোথায় পড়ে যায়।১৫৫ পূর্বের ঘটনায় তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছিল। তাই এবার সাথে সাথে ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবহিত করেন। সময়টি ছিল প্রভাত হওয়ার কাছাকাছি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাত্রা বিরতির নির্দেশ সৈন্যরা যেখানে তাঁবু গেঁড়েছিল সেখানে বিন্দুমাত্র পানি ছিল না। এ দিকে ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেল। লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হযরত আবু বকরের (রা) নিকট ছুটে গিয়ে বললো, ‘আয়িশা (রা) সৈন্য বাহিনীকে কী বিপদের মধ্যে ফেলে দিল। আবু বকর (রা) তখন সোজা ‘আয়িশা (রা) কাছে দৌঁড়ে গেলেন। দেখলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) হাঁটুর উপর মাথা রেখে একটু আরাম করছেন। আবু বকর (রা) উত্তেজিত কণ্ঠে মেয়েকে বললেন, তুমি সব সময় মানুষের জন্য নতুন নতুন মুসীবত ডেকে আন। এ কথা বলে তিনি রাগে-ক্ষোভে মেয়ের পাঁজবে কয়েকটি খোঁচা মারেন। কিন্তু ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরামের ব্যাঘাত হবে ভেবে একটুও নড়লেন না।
এদিকে সকাল হলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুম থেকে গেজে সবকিছু অবগত হলেন। ইসলামী বিধি-বিধানের এ এক বৈশিষ্ট্য যে, সর্বদা তা উপযুক্ত সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামে এর আগে নামাযের জন্য ওযু ফরয ছিল। কিন্তু এই ঘটনার সময় পানি না পাওয়া গেলে কি করতে হবে, সে সম্পর্কে করণীয় কর্তব্য বলে দিয়ে নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হলঃ
‘‘আর যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে থাক কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি প্রস্রাব-পায়খানা থেকে এসে থাকে কিংবা নারী-গমনকরে থাকে, কিন্তু পারে যদি পানি না পায়, তবে পাক-পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করেনাও। তাতে তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও হাতকে ঘষে নাও। নিশ্চয় আল্লাহতা‘আলা ক্ষমাশীল।’’ (আন-নিসাঃ ৪৩)
মূলত তায়াম্মুমের হুকুম একটি পুরষ্কার বিশেষ-যা এ উম্মাতেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলার কতই না অনুগ্রহ যে, তিনি ওযু-গোসল প্রভৃতি পবিত্রতার নিমিত্তে এমন এক বস্ত্তকে পানির স্থালাভিষিক্ত করে দিয়েছেন, যার প্রাপ্তি পানি অপেক্ষাও সহজ। আর এ সহজ ব্যবস্থাটি পূর্ণবর্তী কোন উম্মাতকে দান করা হয়নি, একমাত্র উম্মাতে মুহাম্মদীকেই দান করা হয়েছে।
যা হোক, মুসলিম মুজাহিদদের আবেগ-উত্তেজনায় টগবটে দলটি-যারা তখন পানি না পাওয়ার জন্য নিজেদেরকে বিপদগ্রন্থ মনে করছিল, আল্লাহর এ রহমত লাভে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। হযরত উসাউদ ইবন হুদাউর-যিনি একজন বড় মাপের সাহাবী ছিলেন, আবেগ ভরে বলে উঠলেনঃ‘ওহে আবু বকর সিদ্দীকের পরিবারবর্গ! ইসলামের এটাই আপনাদের প্রথম কণ্যাণ নয়।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, উসাইদ ইবন হুদাইর ‘আয়িশাকে (রা) লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘আল্লাহ আপনাকে ভালো প্রতিদান দিন! আপনার উপর যখনই কোনবিপদ এসেছে-যা আপনি পছন্দ করেন না, তখনই আল্লাহ তার মাধ্যমে আপনার ও মুসলমানদের জন্য কোন না কোন কল্যাণ দান করেছেন।১৫৭
হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) যিনি কিছুক্ষণ আগেই প্রিয়তমা কন্যাকে শিক্ষাদানের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, গর্বের সাথে এখন তিনি সেই কন্যাকে সন্বোধন করে বলছেনঃ ‘আমার কলিজার টুকরা! আমার জানা ছিল না যে, তুমি এতখানি কল্যাণময়ী। তোমার অসীলায় আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে এতখানি বরকত ও আসানী দান করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ‘আয়িশা (রা) এই হারটি বোন আসমার (রা) নিকট থেকে পরার জন্য ধার নিয়েছিলেন।১৫৯ এরপর কাফেলা চলার জন্য যখন ‘আয়িশার (রা) উটটি উঠানো হয় তখন সেই উটের নিচে হারটি পাওয়া যায়।----==----
# == # ঈলা বা তাখঈর-এর ঘটনা:
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) যুগর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা অনেক। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুইটি হলোঃ তাহরীম ও ঈলা বা তাখঈর-এর ঘটনা। তাহরীম হলো মধু সংক্রান্ত সেই ঘটনা যা হযরত হাফসার (রা) জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর ঘটনাটির প্রতি পূর্বে কোথাও কোথাও ইঙ্গিত করা হলেও বিশদ আলোচনা হয়নি, তাই এখানেবর্ণনা করা হলো।
এটা হিজরী ৯ম সন, মতান্তরে আহযাব ও বনু কুরাইজার সমসাময়িক কালের ঘটনা।১৬১ তখন আরবের দূর-দূরান্তের ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলামের বাইতুল মালে প্রতিনিয়ত সম্পদ জমা হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবারের লোকরা যে অভাব-অনটন ও মিতব্যয়িতার ভিতর দিয়ে চলছিলেন, তার কিছু ইঙ্গিত পূর্বেই এসে গেছে। খাইবার বিজয়ের পর যে পরিমাণ শস্যদানা ও খেরারমা খেজুর আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের সারা বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা ছির খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া তাঁদের প্রত্যেকের চিল অতিথি সেবার অভ্যাস ও দান-খায়রাতের হাত। এ কারণে তাঁদের জীবন যাপনের মান ছিলাতি নিম্ন পর্যায়ের। তাদের প্রতিটি দিন কাটতো অনাহার-অর্ধাহারে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের আগে তাঁরা নিজের পিতৃপৃহে অথবা পূর্বের স্বামীর ঘরে অত্যন্ত বিরাসী জীবন যাপন করতেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে অর্থ-সম্পদের আধিক্য দেখে তাঁরা একযোগে তাঁদের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জানান।
এ কথা ‘উমারের (রা) কানে গেলে প্রথমে তিনি নিজের মেয়ে হাফসাকে (রা) এই বলে বুঝালেন যে, তুমি তোমার জীবিকার পরিমাণ বৃদ্ধির দাবী জানাচ্ছো। তোমার যা প্রয়োজন হয় আমার কাছেই চাইতে পার।তারপর হযরত ‘উমার (রা) এক এক করে উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রত্যেকের দরজায় যেয়ে তাঁদেরকে বুঝান। হযরত উম্মু সালামা বলেনঃ উমার! আপনি তো প্রতিটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেই থাকেন, এখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের ব্যাপারও হস্তক্ষেপ করা আরম্ভ করলেন।’ একথা শুনে উমার (রা) অপমাণিত হয়ে চুপ হয়ে গেলেন।’
একদিন আবু বকর ও উমার (রা) দু’জন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলেন, রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘিরে তাঁর স্ত্রীরা বসে আছেন এবং তাঁদের জীবিকার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য তাঁকে চাপচাপি করছেন। উভয়ে নিজনিজ মেয়ে-আয়িশা ও হাফসাকে মারতে উদ্যত হলেন। তখন তাঁরা এই অঙ্গীকার করে আপন আপন পিতার হাত থেকে রক্ষা পেলেন যে, আগামীতে তাঁরা আর জীবিকা বৃদ্ধির দাবী জানিয়ে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কষ্ট দেবেন না।
অন্য স্ত্রীরা তাঁদের দাবীর উপর অটল থাকলেন ঘটনাক্রমে এই সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং পাঁজরে গাছের একটি মূলের সাথে ধাক্কা গেলে আহত হন।
হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরা সংলগ্ন আর একটি ঘর ছির যাকে ‘আল-মাশরাবা বলা হতো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখানেই অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, আগামী এক মাস কোন স্ত্রীর কাছেই যাবেন না।এই ঘটনাটি মুনাফিকরা প্রচvার করে দেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সকল স্ত্রীকে তালাক দান করেছেন। একথা শুনেসাহাবা-ই-কিরাম মসজিদে সমবেত হন। ঘরে ঘরে একটা অস্থিরতার ভাব বিরাজ করতে থাকে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীরা কান্নাকাটি শুরু করে দেন। সাহাবীদের মধ্র থেকে কেউই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ের সাহস করলেন না।
হযরত উমার (রা) খবর পেয়ে-মসজিদে নববীতে এসে দেখলেন, সাহাবায়ে কিরাম বিমর্ষ অবস্থায় চুপচাপ বসে আছেন। তিনি রাসূলে পাকের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে দুইবার কোন সাড়া পেলেন না। তৃতীয় বারের মাথায় অনুমতি পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি চৌকির উপর শুয়ে আছেন, তাঁর পবিত্র দেহে মোটা কম্বলের দাগ পড়ে গেছে। উমার (রা) ঘরের চার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলেন, সেখানে কয়েকটি মাটির পাত্র ও শুকনো মাশক ছাড়া আর কোন জিনিস নেই। এ অবস্থা দেখে উমারের (রা) চোখে অশ্রু নেমে এলো। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আপনার স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন? জবাব দিলেনঃ না। উমার বললেনঃ আমি কি এ সুসংবাদ মুসলমানদের মধ্য প্রচার করে দিব? রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি পেয়ে উমার (রা) গলা ফাটিয়ে আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ওঠেন।
এই মাসটি ছিল ২৯ দিনের। আয়িশা (রা) বলেনঃ আমি একটি একটি করে দিন গুণতাম। ২৯ দিন পূর্ণ হলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।’ রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম আয়িশা (রা) ঘরে যান। তিনি আরজ করেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো এক মাসের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আজ তো উনত্রিশ দিন হলো। তিনি বললেনঃ কোন মাস ২৯ দিনেও হয়।
যেহেতু আযওয়াজে মুহাহ্হারাত জীবন-যাপনের মান বৃদ্ধির দাবীদার ছিলেন অন্যদিকে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহধর্মিণীদের সন্তুষ্টির জন্য পার্থিব ভোগ-বিলাস দ্বারা নিজেকে কলুষিত করতে পারেন না।এই জন্য আল্লাহ তা‘আলা ‘তাখঈর’-এর আয়া নাযিল করেন। ‘তাখঈর’ অর্থ ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা দান করা। অর্থাৎ স্ত্রীদের মধ্যে যাঁর ইচ্ছা দরিদ্র্য ও অভাব-অনটর মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসূলের সাথে সংসার ধর্ম পালন করেন। আর যাঁর ইচ্ছা তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আয়াতটি নিম্নে উদ্ধৃত হলোঃ
‘‘হে নবী! তোমাদের স্ত্রীদের বলঃ তোমরা যদি দুনিয়া ও তার চাকচিক্যই পেতে চাও তবে এসো, আমি তোমাদের কিছু দিয়ে ভালোভাবে বিদায় করে নিই। আর যদি তোমরা আল্লা ও তাঁর রাসূল ও পরকারে ঘর পেতে চাও, তবে জেনে রাখ তোমাদের মধ্যে যারা নেককার, তাদের জন্য আল্লাহ বিরাট পুরষ্কার নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’’ (আল আহযাব :২৯)
মুসলিম শরীফে উল্লেখিত হাদীসে হযরত জাবির ইবন ‘আবদিল্লাহ (রা) সেই সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন যে, একদিন হযরত আবু বকর ও হযরত ‘উমার (রা) নবী কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খিদমতে হাজির হয়ে দেখতে পেলেন যে, হযরতের পত্মীগণ তাঁর চারপাশে বসে আছেন, আর রাসূলও (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চুপচাপ বসে আছেন। তিনি হযরত ‘উমারকে (রা) লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমরা দেখছো, এরা আমার চারপাশে বসে আছে; আসলে এরা আমার নিকট খরচের টাকা চাচ্ছে।’ এই কথা শুনে উভয় সাহাবী নিজ নিজ কন্যাকে খুব করে শাসিয়ে দিলেন এবং তাঁদেরকে বললেনঃ ‘তোমরা রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কষ্ট দিচ্ছ এবং তাঁর নিকট এমন জিনিস চাচ্ছো যা তাঁর নিকট নেই।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, মারতে উদ্যত হলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে থামালেন।১৬৪ বস্ত্তত তখন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কতদূর আর্থিক অনটনের মধ্যে ছিলেন, তা উপরোক্ত ঘটনা হতে স্পষ্ট জানা যায়।
এই আয়াত যখননাযিল হলো, তখন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বপ্রথম হযরত ‘আয়িশার (রা) সাথে কথা বললেনঃ ‘তোমাকে একটি কথা চলছি।, খুব তাড়াতাড়ি করে জবাব দিও না। তোমার পিতা-মাতার মতামত জেনে নাও।’ তারপর নবী কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে উল্লেখিত আয়াতটি পাঠ করে শোনালেন এবং বললেন, আল্লাহর নিকট থেকে এই হুকুম এসেছে। সাথে সাথে হযরত ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ এবিষিয়ে আমার বাবা-মার নিকট কি জিজ্ঞেস করবো? আমি তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং পরকালের সাফল্যই চাই। ‘আয়িশার (রা) এমন জবাবে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারুণ খুশী হলেন। তিনি বললেনঃ বিষয়টি যেভাবে তোমার নিকট উপস্থাপন করেছি সেভাবে তোমার অন্য সতীনদের নিকটও করবো। ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ অনুগ্রহ করে আপনি আমার সিদ্ধান্তের কথাটি অন্য কাউকে জানাবেন না। কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সে অনুরোধ রাখেননি। তিনি যেভাবে ‘আয়িশাকে (রা) কথাটি বলেছিলেন, ঠিক সইভাবে তাঁর সতীনদেরকেও বলেন। সাথে সাথে এ কথাটিও বলে দেন যে, ‘আয়িশা (র) আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আখিরাতকে গ্রহণ করেছে।১৬৫ তাঁদের প্রত্যেকেই ‘আয়িশার মত (রা) একই জবাব দেন। সীরাতের গ্রন্থসমূহে এই ঘটনা ‘তাখঈর’ নামে অভিহিত হয়েছে। ‘তাখঈর’ অর্থ ইখতিয়ার দান করা। স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকবে, নাকি তাঁর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে-এই দুইটিন কোন একটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণকরার ইখতিয়ার স্ত্রীকে অর্পণ করা।
সাইয়েদ আবুল আ‘লা মাওদূদী (রহ) ইবনুল ‘আরাবীর আহকামুল কুরআনের সূত্রে বলেছেনঃ ‘তাখঈর’ এর আয়াত নাযিল হওয়ার সময় হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারজন বেগম বর্তমান ছিলেন। তাঁরা হলেনঃ হযরত সাওদা (রা), হযরত ‘আয়িশা (রা), হযরত হাফসা (রা) ও হযরত উম্মু সালামা (রা)।১৬৬ তবে আল্লামা ইবনকাসীর হযরত ‘ইকরিমার (রা) সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, সেই সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মোট নয়জন বেগম ছিলেন। পাঁচজন কুরাইশ খান্দানের-‘আয়িমা, হাফসা, উম্মু হাবীবা, সাওদা ও উম্মু সালামা (রা) এবং অন্যরা হলেন-সাফিয়্যা, মাইমুনা, জুওয়াইরিয়া ও যয়নাব বিতন জাহাশ আল-আসাদিয়্যা (রা)।১৬৭ ঘটনার সময়কাল নিয়ে মতভেদের কারণে এই পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে।----==----
# == # স্বামীর ইনতিকাল -
হযরত ‘আয়িশার (রা) বয়স যখন আঠারো বছর তখন স্বামী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকাল করেন। হিজরী ১১ সনের সফর মাসের পূর্বে কোন একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার (রা) ঘরে এসে দেখেন, তিনি মাথার যন্ত্রণায় আহ উহ করছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এ অবস্থা দেখে বললেনঃ তুমি যদি আমার সামনে মারা যেতে, আমি তোমাকে নিজ হাতে গোসল দিয়ে কাফন-দাফন করতাম। ‘আয়িশার (রা) সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া জানালেন এভাবেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো একথা বলছেন এ জন্য যে, যাতে এই ঘরে অন্য একজন স্ত্রীকে এনে উঠাতে পারেন। একথা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেনঃ হায় আমার মাথা! বলা হয়েছে, মূলত তখন থেকেই রাসূলাল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়।১৬৮ এরপর তিনি হযরত মায়মূনার (রা) ঘরে গিয়ে শয্যাশয়ী হয়ে পড়েন। এ অবস্থায়ও তিনি নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট স্ত্রীর ঘরে রাত কাটাতেন। কিন্তু প্রত্যেক দিনই জানতে চাইতেন, আগামী কাল তিনি কোথায় থাকবেন? স্ত্রীগণ বুঝতে পারলেন তিনি ‘আয়িশার (রা) কাছেই থাকতে চাচ্ছেন। তাই তাঁরা সবাই অনুমতি দিলেন। সেই দিন থেকে পার্থিবীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ‘আয়িশার (রা) ঘরে অবস্থান করেন।
এখন কারো মনে এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আয়িশার (রা) কাছে যাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল ছিলেন কেন? তাঁকে অতিমাত্রায় ভালোবসার কারণে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা নয়। মূলত আল্লাহ ‘আয়িশাকে (রা) যে পরিমাণ বুদ্ধি, মেধা, স্মরণশক্তি, স্বভাবগত পূর্ণতা এবং চিন্তাশক্তি দান করেছিলেন তা জন্য কোন স্ত্রীর মধ্যে ছিল না। সুতরাং এমন ধারণা অমূলক নয় যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উদ্দেশ্যে ছিল, তাঁর জীভনের শেষ দিনগুলির যাবতীয় কথা, কাজ ও আচরণ যেন পূর্ণরূপে সংরক্ষিত থাকে। বাস্তবে তাই হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতে সংক্রান্ত অধিকাংশ সহীহ বর্ণনা ‘আয়িশার (রা) মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছেছে।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোগের তীব্রতা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি ইমামতির জন্য মসজিদে যেতে অক্ষম হয়ে পড়েন। সহধর্মিণীগণ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে শেখা কিছু দু‘আ পড়ে তাঁরা ফুঁক দিচ্ছিলেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) কিছু দু‘আ পড়ে ফুঁক দিয়েছিলেন।
ফজরের নামাযে সমবেত মুসল্লীরা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তিনি কয়েকবার ওঠার চেষ্টা করতেই অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। অবশেষে তিনি আবু বকরকে (রা) ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। ‘আয়িশা (রা) বলেন, আমার ধারণা হলো, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্থলে যিনিই দাঁবাবেন মানুষ তাঁকে অপাংক্তেয় ও অশুভ মনে করবে। এজন্য আমি বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর একজন নরম দিলেন মানুষ। তাঁরা দ্বারা এ কাজ হবে না। তিনি কেঁদে ফেলবেন। অন্য কাউকে নির্দেশ দিন। কিন্তু তিদ্বিতীয়বার একই নির্দেশ দিলেন। তখন ‘আয়িশা (রা) হাফসাকে (রা) অনুরোধ করলেন কথাটি আবার রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মন্তব্য করলেনঃ ‘তোমরা সবাই ইউসুফের সঙ্গিনীদের মত। বলে দাও, আবু বকর ইমামতি করবেন।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুস্থ হয়ে পড়ার পূর্বে কিছু নগদ অর্থ ‘আয়িশার (রা) নিকট রেখে খরচ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। এখন এই প্রবল রোগের মধ্যে সে কথা স্মরণ হলো। ‘আয়িশাকে (রা) বললেনঃ সেই দিরহামগুলি কোথায়? ওগুলি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেল। মুহাম্মদ কি বিরূপ ধারণা নিয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে? তখনই সেই অর্থ দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
এখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ সময়। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথার কাছে বসা এবং তিনিও ‘আয়িশার (রা) সিনার সাথে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুস্থতার জন্য দু‘আ করে চলেছেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাত তাঁর হাতের মধ্যেই। হঠাৎ নি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেনঃ
আরবী হবে (আল্লাহুমা ওয়ার রাফীকিল আ‘লা)
অর্থাৎ, আল্লাহ! আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুকেইগ্রহণ করছি। ১৭৩
‘আয়িশা (রা) বলেনঃ সুস্থ অবস্থায় তিনি বলতেন, প্রত্যেক নবীর মরণকালে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের যে কোন একটি বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই শব্দগুলি উচারণের পর আমি বুগগেলাম যে, তিনি আমাদের থেকে দূরে থাকেই কবুল করেছেন।১৭৪ তিনি আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার তো বড় কষ্ট হচ্ছে। বললেনঃ কষ্ট অনুপাতে প্রতিদানও আছে।
‘আয়িশার (রা) হযরত রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামলে নিয়ে বসে আছেন। হঠাৎ তাঁর দেহের ভার অনুভব করলেন। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, তিনি আর নেই। আস্তে করে পবিত্র মাথাটি বালিশের উপর রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
হযরত ‘আয়িশার (রা) সবচেয়ে বড় সম্মান ও মর্যাদা এই যে, তাঁরই ঘরের মধ্যে, এক পাশে রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র দেহ সমাহিত করা হয়। ১৭৬
একবার হযরত ‘আয়িশা (রা) স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর ঘরে একের পর এক তিনটি চাঁদ ছুটে এসে পড়ছে। তিনি এই স্বপ্নের কথা পিতা আবু বকর সিদ্দীককে (রা) বলেন। যখন রাসূলে কারীমকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে দাফন করা হলো তখন আবু বকর (রা) মেয়েকে বললেন, সেই তিন চাঁদের একটি এই এবং সবচেয়ে ভালোটি।১৭৭ পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, তাঁর স্বপ্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় চাঁদ ছিলেন আবু বকর (রা) ও ‘উমার (রা)।
হযরত ‘আয়িশা (রা) আঠারো বছর বয়সে বিধবা হন এবং এ অবস্থায় জীভনের আরো আটচল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেন। যতদিন জীবিত ছিলেন, কবর পাকের পাশেই ছিলেন। প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের পাশেই ঘুমাতেন। একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নে দেখার পর সেখানে ঘুমোনো ছেড়ে দেন। হযরত ‘আমারকে (রা) ‘আয়িশার (রা) ঘরে দাফন করার পূর্ব পর্যন্ত হিজাব ছাড়া আসা-যাওয়া করতেন। কারণ, তখন সেখানে যে দুই জন শায়িত ছিলেন, তাঁদের একজন স্বামী এবং অপরজন পিতা। তাঁদের পাশে ‘উমারকে (রা) দাফন করার পর বলতেন, এখন ওখানে যেতে গেলে হিজাবের প্রয়োজন হয়।
আল্লাহ পাক আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের (পবিত্র সহর্ধমিণীগণ) জন্য দ্বিতীয় বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ইবন ‘আববাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলো যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর তাঁর কোন এক স্ত্রীকে বিয়ে করবে। ইে হাদীসের বর্ণনা সূত্রের একজন বর্ণনাকারী সুফইয়ানকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলোঃ তিনি কি ‘আয়িশা (রা)? সুফইয়ান বললেনঃ বর্ণনাকারীরা তাই উল্লেখ করেছেন। সুদ্দী বলেনঃ যে ব্যক্তি এমন ইচ্ছা করেছিলেন, তিনি হলেন তালহা ইবন ‘উবাইদিল্লাহ। এরই প্রেক্ষিতে নিম্নের আয়তাটি নাযিল হয়ঃ১৭৮
‘আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর পত্মীগণকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ। ১৭৯
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক আযওয়াজে মুতাহ্হারাতকে মুসলমানদের জননী বলে ঘোষণা দেন। ১৮০
‘নাবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা।’
মূলকথা হলো, আযওয়াজে মুতাহ্হারাত-যাঁরা তাঁদের জীবনের একটি অংশে মহানবীর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন সঙ্গিনী ছিলেন, তাঁদের বাকী জীবনটাও স্বামীর শিক্ষা ও কর্মের অনুশীলন এবং চার-প্রসারে অতিবাহিত করবেন। তাঁরা মুসলমানদের মা। তাঁদের দায়িত্ব হবে সন্তানদের তা‘লীম ও তারবিয়্যাত (শিখ্সা ও প্রশিক্ষণ) দান করা। তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বয়ং আল্লাহ বলে দিয়েছেন এভাবেঃ১৮১
‘হে নবী পত্মীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না। ফলে সেই ব্যক্তি কু-বাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানকরবে-প্রথম জাহিলী যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। যামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পুত-পবিত্র রাখতে। আল্লাহর আংাত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে সঠিত হয়, তোমরা সেগুলো স্মারণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্ব বিষখেবর রাখেন।’
হযরত ‘আয়িশার (রা) বাকী জীবন ছির উপরে উদ্ধৃত আল্লাহর বাণীর বাস্তব ব্যাখ্যাস্বরূপ। হযরত রাসূল কারীমের (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশার (রা) সম্মাণিত পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) খলীফা নির্বাচিত হলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফন-দাফন ও খলীফা নির্বাচনের ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমগণ চাইলেন, হরত উসমানকে (রা) তাঁদের পক্ষ থেকে খলীফার নিকট পাঠাবেন উত্তরাধিকারের বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য। তখন ‘আয়িশা (রা) তাঁদেরকে স্মরণকরিয়ে দিলেন যে, রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘আমার কোন উত্তারাধিকারী থাকবে না। আমার পরিত্যক্ত সবকিছু সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।১৮২ এ কথা শুনে সবাই চুপ হয় যান।
আসলে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিষয়-সম্পত্তি এমন কী-ইবা রেখে গিয়েছিলেন, যা তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হতে পারতো? হাদীসে এসেছে, তিনি দিরহাম ও দীনার, চতুস্পদ জন্তু, দাস-দাসী কিছুই মীরাছ হিসেবে রেখে যাননি।১৮৩
তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হিসেবে কয়েকটি বাগ-বাগিচা তিনি নিজের অধীনে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় তার আয় যে যে খাতে ব্যয় করতেন, খিলাফতে রাশেদাও তা একই অবস্থায় বহাল রাখেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগমগণের ব্যয় নির্বাহ করতেন এরই আয় থেকে, আবু বকরও (রা) তা বহাল রাখেন।১৮৪----==----
# == # পিতৃবিয়োগ -
হযরত আবু বকর (রা) মাত্র দুই বছর খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পান। হিজরী তেরো সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর যখন অন্তিম দশা তখন মেয়ে ‘আয়িশা (রা) পিতার শিয়রে বসা ছিলেন। এর আগে সুস্থ অবস্থায় তিনি মেয়েকে কিছু বিষয়-সম্মতি ভোগ-দখলের জন্য দিয়েছিলেন। এখন অন্য সন্তানদেরও বিষয়-সম্মতির প্রয়োজনের কথা মনে করে বললেনঃ আমার কিলজার টুকরো মেয়ে! তুমি কি ঐ বিষয়-সম্পত্তি তোমার অন্য ভাইদের দিয়ে দিবে? মেয়ে বললেনঃ অবশ্যই দব। তারপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেসকরেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফনে মোট কতখানা কাপড় ছিল? মেয়ে বললেনঃ তিনখানা সাদা কাপড়। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কোন দিন ওফাত পান? বললেনঃ সোমবার। আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি বার? বললেনঃ সোমবার বললেনঃ তাহলে আজ রাতে আমাকেও যেতে হবে। তারপর তিনি নিজের চাদরটি দেখেলেন। তাতে জাফরানের দাগ ছিল। বললেনঃ এইকাপড়খানি ধুয়ে তার উপর আরো দুইখানি কাপড় দিয়ে আমাকে কাফন দিবে। মেয়ে বললেনঃ এই কাপড় তো পুরানো। বললেনঃ মৃতদের চেয়ে জীবিতদেরই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশি।১৮৫ সেই দিন রাতেই তিনি ওফাত পান। হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরার মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে, একটু পায়ের দিকে সরিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত ‘আয়িশার (রা) হুজরায় পতিত এটা হলো দ্বিতীয় চাঁদ। এত অল্প বয়সে স্বামী হারানোর মাত্র দুই বছরের মধ্যো তিনি পিতাকে হারালেন।----==----
# == # খিলাফতে ফারুকীঃ
হযরত ফারুকে আজমের (রা) খিলাফতে কালটি ছির সর্বদিক দিয়ে উৎকর্ষমন্ডিত। তিনি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নগদ ভাতা নির্ধারণ করে দে। একটি বর্ণনা মতে, তিনি আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রত্যেকের জন্য বাৎসিক বারো হাজার করে দিতেন।১৮৬ অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, অন্য আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রক্যেককে দশ হাজার এবং আয়িশাকে (রা) বারো হাজার দিতে। এমন প্রাধান্য দানের কারণ উমার (রা) নিজেই বলে দিয়েছে। আমি তাঁকে দুই হাজার এই জন্য বেশি দিই যে, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক প্রিয়পাত্রী।
আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের সংখ্যা অনুযায়ী খলীফা উমার (রা) নয়টি পিয়ালা তৈরি করান। যখন কোন জিনিস তাঁর হাতে আসতো, নয়টি ভিন্ন ভিন্ন পিয়ালা সকলের নিকট পাঠাতেন। হাদিয়া-তোহফা বণ্টনের সময় এতখানি খেয়াল রাখতেন যে, কোন জন্তু জবেহ হলে তার মাথা থেকে পায়া পর্যন্ত তাঁদের নিকট পাঠাতেন।
ইরাক বিজয়ের এক পর্যায়ে মূল্যবান মোতি ভর্তি একটি কৌটা মুসলমানদের হাতে আসে। অন্যান্য মালে গনীমতের সাথে সেটিও খলীফার দরবারে পাঠানো হয়। এই মোতির বণ্টন সকলের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। খলীফা উমার (রা) বললেনঃ আপনারা সকলে অনুমতি দিলে এই মাতাতিগুলি আমি উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠিয়ে দিতে পারি। কারণ, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক দিতে পারি। কারণ, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)সর্বাধিক প্রিয়পাত্রী। পাত্রটি ‘আয়িশার (রা) নিকট পাঠানো হলো। তিনি সেটা খুলে দেখে বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে ইবন খাওাব আমার প্রতি অনেক বড় বড় অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। হে আল্লহ! আগামীতে তাঁর এমনসব অনুগ্রহ লাভের জন্য আমাকে জীবিত রেখো না।
খলীফা হযরত ‘উমারের (রা) বাসনা ছিল, ‘আয়িশার (রা) হুজরায় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কদম মুবারকের কাছে দাফন হওয়াব। কিন্তু একথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর কারণ, যদিও মাটির নীচে চলে গেলে শরীয়াতের দৃষ্টিতে পুরুষদের থেকে পর্দা করা জরুরী নয়, বতুও আদব ও শিষ্টাচারের দৃষ্টিতে দাফনের পরেও তিনি আয়িশার নিকট গায়ের মাহরামই মনে করতেন। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে এসব চিন্তায় তিনি বড় পেরেশান ছিলেন। শেষমেষ ছেলেকে পাঠালেন এই বলে যে, ‘উম্মুল মুমিনীনকে আমার সালাম পেশ করে বলবে, ‘উমারের বাসনা হলো তাঁর দুই বন্ধুর পাশে দাফন হওয়ার।’ ‘আয়িশা (রা) বললেনঃ ‘যদিও আমি ঐ স্থানটি নিজের জন্য রেখেছিরাম, তবে আমি সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।’
উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশার (রা) এই অনুমতি পাওয়ার পরেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে ‘উমার (রা) অসীয়াত করে গেলেন, আমার লাশবাহী খাটিয়া তাঁর দরজায় নিয়ে গিয়ে আবার অনুমতি চাইবে। যদি তিনি অনুমতি দান করেন তাহলে ভিতরে দাফন করবে। অন্যথায় দাফন করবে সাধারণ মুসলমাদের গোরস্থানে। খলীফার ইনতিকালের পর তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হয়। ‘আয়িশা (রা) দি্তীয়বার অনুমতি দান করেন এবং লাশ ভিতরে নিয়ে দাফন করা হয়।১৮৭
আর এভাবে তিনি হলেন হযরত ‘আয়িশার (রা) স্বপ্নের তৃতীয় চাঁদ-যাঁর মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়।
বিদ্রোহীদের হাতে খলীফা হযরত উসমানের (রা) শাহাদাত বরণ ইসলামের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। এরই প্রেক্ষিতে উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) সরাসরি তৎকালী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আর তাঁরপপ্রেক্ষাপটে ঘটে আর এক হৃদয়বিদারক ঘটনা উটের যুদ্ধ। হযরত ‘উসমানের (রা) শাহাদাত পরবর্তী ঘটনাবলীতে তাঁর এভাবে জড়িয়ে পড়া কতটুকু ঠিক বা বেঠিক ছিল, সে বিষয়ে আমরা কোন সিদ্ধান্তে যাবনা। আমরা শুধু বিশ্বাস করবো, তাঁর সকল কর্ম-প্রচেষ্টা নিবন্ধ ছিল দীন ও উম্মাহর কল্যাণের জন্য। ঐতিহাসিক এ সকল ঘটনা বুঝার জন্য একটু বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন।
হযরত ‘উসমানের (রা) খিলাফাতকাল প্রায় বারো বছর। এ সময়ের প্রথম অর্ধাংশে সকল প্রকার ঝামেলা ও হৈ-হাঙ্গামা মুক্ত শান্ত পরিবশে বিরাজমান ছিল। তারপর ধীরে ধীরে জনগণের পক্ষ থেকে নানা রকম অভিযোগ উঠতে থাকে। হযরত ‘আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘উসমানকে (রা) উপদেশ দিয়েছিলেন, যদি আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কখনও খিলাফতের জামা পরান তাহলে স্বেচ্ছায় তা যেন খুলে না ফেলেন।১৮৮
মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে হযরত ‘আয়িশার (রা) খুবই গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আল্লাহ তা‘আলারvাষণা অনুযা্য়ী তিনি ছিলেন মুসলমানদের মা। হিজায, ইরাক, মিসর তথা খিলাফতের প্রতিটি অঞ্চলে তাঁকে মায়ের মত মানা হvাত। লোকেরা তাঁর নিকট এসে নিজেদের নানা অভিযোগ ও অসুবিধার কথা বলতো, আর তিনি উপদেশ ও সান্তুনা দিতেন।
হযরত ‘উসমানের (রা) খিলাফতের প্রথম পর্ব পর্যন্ত বড় মাপের প্রজ্ঞাবান সাহাবীরা জীবিত ছিলেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করা হতো। খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁদেরকে নিয়োগ দান করা হতো। পূর্ববর্তী দুই খলীফার সময়ে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। সে সময় যাঁরা উচ্চাভিলাষী যবক ছিলেন-যেমন ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর, মুহাম্মদ ইবন আবী বকর, মারওয়ান ইবনহাকাম, মুহাম্মদ ইবন আবী হুজায়ফা, সা‘ঈদ ইবন আল-আস প্রমুখ, তাঁরা বড়দের সাহায্য করতেন। খিলাফত এবং ইমারাতের কোন উঁচু পদ ছির তাঁদের জন্য দুরাশা মাত্র।
‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) ছিলেন হযরত সিদ্দীকে আকবরের নাতী এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফুফাতো ভাই ও হাওয়ারী যুবাইয়ের (রা) ছেলে। তিনি নিজেকে খিলাফতের একজন হকদার মনে করতেন।
মুহাম্মদ ইবন আবী বকর ছিলেন প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) ছোট ছেলে এবং উম্মুল মুমিনীন আয়িশার (রা) বৈমাত্রেয় ভাই। এই মুহাম্মাদের মাকে আবু বকরের মৃত্যুর পর আলী (রা) বিয়ে করেন। এ কারণে আলীর (রা) নিকট লালিত-পালিত হন।১৮৯ আর আলীও (রা) তাঁকে ছেলের মত দেখতেন।
মুহাম্মদ ইবন আবী হুজায়ফা বেড়ে ওঠেন হযরত উসমানের (রা) তত্ত্বাবধানে। বয়স হলে খলীফা উসমানের (রা) নিকট কোন একটি বড় পদের আশা করেন। খলীফা তাঁকে যোগ্য মনে না করায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে মদীনা ছেড়ে মিসর চলে যান।
‘মারওয়ান ও সা‘ঈদ ইবন ‘আস উভয়ে উমাইয়্যা বংশের দুই নব্য যুবক ছিলেন। উঁচু মর্যাদার অধিকারী মুহাজিরদের ইনতিকালের পর তাঁদের সন্তানরাও খিলাফতের নিকট বহু কিছু প্রাপ্তির আশা নিয়ে এগিয়ে আসেন। হযরত ‘উসমান (রা) উমাইয়্যা খান্দানের লোক ছিলেন। তাই তিনি যখনই মারওয়ান ও সা‘ঈদ ইবন ‘আসের মত লোকদের উঁচুপদ দান করলেন, তখন কুরাইশ-খান্দানের অন্যসব উচ্চাভিলাষী যুবকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। এ কারণে মুহাম্মদ ইবন আবী বকর ও মুহাম্মদ ইবন আবী হুজায়ফা ‘উসামন (রা) বিরোধী বিক্ষোভে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়া এই সকল নওজোয়ানের মধ্যে উঁচু স্তরের সাহাবায়ে কিরামের মত সাম্য ও ন্যায়পরায়ণতা, সততা, আমানতদারি, তাকওয়া খোদাভীতি ছিল না। এ কারণে জনসাধারণ ও সৈনিকদের মধ্যে যাঁরা প্রথম স্তরের সাহবীদেরকে দেখেছিলেন, তারা এই লোকদের নেতৃত্ব ও শাসনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আরবরা ছির চির স্বাধীন। মরু প্রকৃতিতে তারা স্বাধীন আবহাওয়ায় বেড়ে উঠতো। প্রত্যেকেই নিজ জি গোতের আনুগত্য করতো এবং নিজের গোত্রকে অন্য গোত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতো। ইসলামী সাম্যের আদর্শ তাদের সকল আভিজাত্য ভুলিয়ে দেয় এবং তাদেরকে একই স্তরে নামিয়ে আনে। প্রথম স্তরের সাহাবায়ে কিরাম (রা) ইসলামী সাম্যের শিক্ষা সমুন্নাত রাখলেও তাঁদের পরবর্তী নতুন প্রজম্নের কর্মকর্তা ও পদাধিকারী ব্যক্তিরা যেমন তা ভুলে বসেন, তেমনি অন্যদেরকেও ভুলিয়ে দেন। তাঁরা প্রকাশ্যে নিজেদের মজলিস ও দরবারে নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা ও গোত্রীয় আভিজাত্য প্রকাশ করতে শুরু করেন। অন্যান্য আরব গোত্রসমূহ তাঁদের এমন মনোভাব ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তারা ছিল সম অধিকারের দাবীদার। অন্যদিকে নওমুসলিম আনারব গোষ্ঠী কুরাইশ বা বনু উমাইয়্যা কোন আরব গোত্রেরই শাসন সহ্য করতে পারছিল না। এই জন্য খিলাফতের অভ্যন্তরে যে কোন ধরনের হৈ-হাঙ্গামায় অতি উৎসাহের সাথে তারা অংশগ্রহণ করতো।
আরব-আজমের মিলনস্থলরূপে যে কয়টি শহর চিহ্নিত ছিল তার মধ্যে কূফান্যতম। ইসলামী খিলাফতের ফিতনার সূচনা এই শহর থেকেই হয়। এটি ছির আরব গোত্রসমূহের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সা‘ঈদ ইবনুল ‘আস ছিলেন এই কূফার ওয়ালী। রাতের বেলা তাঁর দরবারে সকল গোত্রের সর্বদাদের মাজমা বসতো। সাধারণত আরবদের যুদ্ধ বিগ্রহ ও আরব গোত্রসমূহের মর্যাদার তারতম্য বিষয়ে আলোচনা হতো। আর বিষয়টি এমন ছিল যে, কোন গোত্রই অন্য গোত্র থেকে মর্যদায় খাটো মনে করতো না। অনেক সময় আলোচনা তর্ক-বির্তক, ঝগড়া-ঝাটি ও মারামারিতে রূপ নিত। এ ক্ষেত্রে সা‘ঈদ ইবন ‘আসের মুখে নিজেকে কুরাইশ বংশজাত বলে গর্বের সাথে প্রকাশ করা আগুনে তেল ঢালার মত কাজ করতো। তাঁর এমন কর্মপন্থায় গোত্রীয় নেতাদের অভিযোগ সৃষ্টি হয়। মূলত তা একটি ফিতনার রূপ ধারণ করে।
ঠিক এই সময়ে ইবন সাবা নামক এক ইহুদী মুসলমান হয়। ইহুদীদের নিয়ক হলো, শক্র হিসেবে যদি শক্রর ক্ষতি না করতে পারে তাহলে রূপ পাল্টে বন্ধু হয়ে যায়। তারপর ধররে ধীরে গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমের শক্রর সর্বনাশের চূড়ান্ত করে ছাড়ে। অতীতে খৃষ্টধর্মের সাথে তারা এমন আচরণই করেছিল।
এই ইহুদীর সন্তান ইবন সাবা জনগণের মধ্যে এই কথা প্রচার কতে থাকে যে, হযরত ‘আলী (রা) প্রকৃত পক্ষে খিলাফতের হকদার। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর খলীফা হওয়ার ব্যাপারে অসীয়াতকরে গিয়েছিলেন। সর্বশক্তি দিয়ে সে তাঁর এই ভ্রান্তবিশ্বাস প্রচার করতে থাকে। খিলাফতের বিভিন্ন ছোটখাট রাজনৈতিক হৈ-চৈ কে বাহানা বানিয়ে সে তার ষড়যন্ত্রের জালকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। সে গোটা খিলাফত চষে ফেলে। কূফা, বসরা, মিসর তথা যেখানে বড় বড় সৈন্য ছাউনী ছিল সেখানে কিছু না কিছু বিপ্লবপন্থী সে তৈরি করে। সে মিসরকে এবিপ্লবপন্থীদের কেন্দ্র বানিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলে। ইতিহাসে এটাকে ‘সাবায়ী’ আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
খলীফা উসমানের (রা) সময়ে আক্রি্কাতেই অধিকাংশ যদ্ধ-বিগ্রহ চলছিল। একারণে সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশ সেখানেই থাকতো। যুদ্ধে অংশগ্রহণের বাহানায় মুহাম্মদ ইবন আবী বকর ও মুহাম্মদ ইবন আবী হুজায়ফা স্বাধীনভাবে সৈন্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেতেন এবং তাদের মধ্যে অসন্তোষের বীজ রোপণ করতেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যে মিসর ‘উসমান (রা) বিরোধী বিদ্রোহের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে ওঠে। আর সেই সময় ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী সারাহ মিসরের ওয়ালী ছিলেন। মুহাম্মদ ইবন আবী বকর, মুহাম্মদ আবন আবী হুজায়ফা ও অন্যরা ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী সারাহও খলীফা ‘উসমানের (রা) বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করে দিলেন। এভাবে তাঁরা মিসরে নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা পরিণত হলেন।
হজ্জের মওসুম এসে গেল। পারস্পরিক যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত মুতাবিক কূফা, বসরা ও মিসর থেকে এক হাজার মানুষের একটি দল হজ্জের বাহানায় হিজাযের দিকে যাত্রা করলো এবং মদীনার কাছাকাছি এসে শিবির স্থাপন করলো। হযরত ‘আলী (রা) ও অন্য বড় বড় সাহাবীরা তাদেরকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিলেন। তারা কিছুদূর যেতে আবার ফিরে আসে এবং মিসরের গবর্ণরের নিকট লেখা একটি চিঠি দেখায়। তাতে মিসরের গভর্নরের প্রতি খলীফার নির্দেশ ছিল, মিসরী বিদ্রোহীদের নেতৃবৃন্দকে মিসর প্রত্যাবর্তনের পরপরই হত্যা অথবা বনঈ করার। বিদ্রোহীদের ধারণা মতে, এই পত্রখানি ছিল খলীফার সেক্রেটারী মারওয়ানের হাতের লেখা। এ কারণে তারা সমবেতভাবে খলীফা উসমানের (রা) বাড়ী ঘেরাও করে এবং খলীফার নিকট দুইটি প্রস্তাব পেশ করে। হয় তিনি মারওয়ানকে বিদ্রোহীদের হাতে অর্পণ করবেন অথবা তিনিনিজেই পদত্যাগ করবেন। হযরত ‘উসমান দুইটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন।
হযরত ‘আয়িশা (রা) তখন মদীনায়। তিনি বৈমাত্রেয় ভাই মুহাম্মদ ইবন আবী বকরকে ডেকে বুঝালেন এবং খলীফার বিরুদ্ধে এমন চরম সিদ্ধান্ত থেকে বিতর থাকতে বলরেন। কিন্তু তিনি বোনের কথায় কান দিলেন না।
মদীনায় যখন এমন একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান, তখন হযরত ‘আয়িশা (রা) প্রতিবছরের মত হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে গেলেন। অবশ্য তিনি মুহাম্মদ ইবন আবী বকরকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে রাজি করাতে পারেনী। তারপর কিছুদিন হযরত ‘উসমান (রা) নিজ গৃহে অবরুদ্ধ থাকেন এবং অবশেষে বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদান বরণ করেন।
হযরত ‘উসমান (রা) বিদ্রেীহাীদের হাতে শাহাদাত বরণ করলেন। এখন একজন নতুন খলীফা নির্বাচনের পালা। স্বাভাবিক ভাবেই সকলের দৃষ্টি সেই চারজন জীবিত বিশিষ্ট সাহাবীর প্রতি পড়ার কথা, যাঁরা খলীফা হযরত ‘উমারের (রা) মনোনীত ছয় সদস্যের খলীফা গ্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। তারা হলেনঃ তাহলা, যুবাইর, সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস ও আলী (রা)। এ সময় সা‘দ (রা) একেবারেই নিজেকে দূরে সরিয়ে মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে চয়ে যান। বসরার অধিবাসীরা তালহার (রা) পক্ষ অবলম্বনকারী ছিল। মিসরবাসীদের একাংশ ছিল যুবাইরের (রা) পক্ষে; কিন্তু অপর অংশ এবং বিপ্লবীদের গরিষ্ঠ অংশ ছিল আলীর (রা) পক্ষে। ‘আলীর (রা) সমর্থকদের মধ্যে আগ্রণী ভূমিকা পালন করছিলেন আশতার নাখ‘ঈ, ‘আম্মার ইবন ইয়াসির ও মুহাম্মদ ইবন আবী বকর (রা)। এমনিভাবে প্রত্যেক দল বা গোষ্ঠী নিজেদের পছন্দনীয় ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে থাকে। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ‘উমারের (রা) ছেলে ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার, তৃতীয় খলীফা হরত ‘উসমানের (রা) ছেলে আবান ও প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) ছেলে আবদুল রহমানের নামটিও প্রস্তাবে আসে। দীর্ঘ আলোচনা, পর্যালোচনা ও কর্ত-বির্তকের পর বিদ্রেহীদের চাপ ও মদীনাবাসীদের ইচ্ছায় হযরত ‘আলীকে (রা) খলীফা নির্বাচন করা হয়।১৯০
মদীনায় যখন এ সকল ঘটনা ঘটছে তখন সিরিয়ায় হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা) স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন এবং মুহাম্মদ ইবন আবী হুজায়ফা মিসরে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে বসে আছেন। মদীনার পবিত্র ভূমিতে পবিত্র মাসে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফা এবং মুসলিম জাহানের ইমামের এমন নৃশংস হত্যাকান্ড সর্বশ্রেণীর মানুষর অন্তরে দারুণ ছাপ ফেলে। পূর্বে যাঁরা হযরত ‘উসমানের (রা) কর্মপদ্ধতির সমালোচক ছিলেন, তাঁরাও এহেন ঘৃণিত কাজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। হযরত ‘আয়িশাও (রা) এই শ্রেণীর লোকদের অন্যতম। এমন বাড়াবাড়ি তাঁরে কেউই চাননি। এই ঘটনার পূর্বে আশতার নাখ‘ঈ একদিন ‘আয়িশাকে (রা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, আল্লাহর পানাহ্! আমি ইমামদের ইমামকে হত্যার কথা বলতে পারি? এতেই ফিতনাবাজ লোকেরা রটিয়ে দেয় যে, উসমান (রা) হত্যাকান্ডে ‘আয়িশারও (রা) সমর্থন ছিল। তাছাড়া, মাুষের এমন ধারণার আরেকটি কারণ ছিল। তা হলো তাঁর ছোট সৎ ভাই মুহাম্মদ ইবন আবী বকর (রা) ছিলেন বিদ্রোহীদের অন্যতম নেতা।
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি হযরত ‘আয়িশা (রা) তাঁর ভাইকে ‘উসমান (রা) বিরোধী হঠকারী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হযরত ‘আয়িশা (রা) পরবর্তীকালে একবার হযরত ‘উসমানের (রা) আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি কখনও চাইনি যে ‘উসমানের (রা) কোন রকম অসম্মান হোক। আমি যদি তা চেয়ে থাকি তাহলে আমারও যেন তার মত পরিণতি হয়। হে ‘উবাইদুল্লাহ ইবন ‘আদী! (আদী ছিলেন ‘আলীর রা. পক্ষে) একথা জানার পর কেউ যেন তোমাকে ধোঁকা দিতে না পারে। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কর্মকান্ডকে কেউ ততদিন অসম্মান করতে পারেনি যতদিন তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়নি। যে ‘উসমানের সমালোচনা করেছে, সে এমন সব কথা বলেছে যা বলা উচিত ছিল না। আমরা তাদের কর্মকান্ডকে গভীরভাবে দেখেছি, তাতে বুঝেছি তা সাহাবীদের কর্মকান্ডের ধারে কাছেও ছির না।’ ইতহিাস ও সীরাতের গ্রন্থে হযরত ‘আয়িশার (রা) এ জাতীয় এমনানেক কথা পাওয়া যায়, যা দ্বারা বুঝা যায় ‘উসমান (রা) এ জাতীয় এমন অনেক কথা পাওয়া যায়, যা দ্বারা বুঝা যায় ‘উসমান (রা) হত্যার ব্যাপারে তার কোন রকম ভূমিকা ছিল না। তাঁর প্রতি যে দোষারোপ করা হয়েছিল তা ছিল বিদ্রোহীদের একটি অপপ্রচার মাত্র।
মদীনার এই মর্মবিদারী ঘটনায় তৎকালীন গোটা মুসলিম উম্মাহ শোকে কাতর হয়ে পড়ে। সাহাবায়ে কিরামের ছোট্ট একটি দল, যাঁরা নিজেদের দেহের রক্ত দিয়ে গড়া উদ্যান তছনছ হতে দেখছিলেন-স্থির থাকতে পারলেন না। তাঁরা এর একটা দফারফা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। এ দলটির নেতৃত্বে ছিলেন তিনিজন মহান সাহাবীঃ উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশা, হযরত যুবাইর ও হযরত তালহা (রা)। হযরত তালহা (রা) ছিলেন কুরাইশ খান্দারন লোক এবং প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রাঃ) কন্যার স্বামী, ইসরামের আদি পর্বের একজন সুমলমান এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমলে সংঘটিত সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদ। যুবাইর ইসলামের একজন বীর সৈনিক। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফূফাতো ভাই এবং প্রথম খলীফার কন্যা হযরত আসমার (রা) স্বামী। উভয়ে ছিলেন দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের (রা) মনোনীতখলীফা প্যানেলের অন্যতম সদস্য।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনায় যখন খলীফা উসমান (রাঃ) বহিরাগত বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ তখন হযরত আয়িশা (রা) প্রতি বছরের অভ্যাসমত হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে যান। হজ্জ শেষ করে মদীনায় ফিরছিলেন, এমন সময় খলীফা উসমানের (রা) শাহাদাতের খবর পেরেন। সামনে কিছুদূর অগ্রসর হতেই হযরত তালহা ও যুবাইরের (রা) সাক্ষাৎ পেলেন। তাঁরা খলীফা হযরত আলীর (রা) অনুমতি নিয়ে মদীনা থেকে বেরিয়ে মক্কার দিকে যাচ্ছেন। তাঁরা তখন হযরত আয়িশার (রা) নিকট মদীনার আইন-শৃঙ্খলার যে চিত্রতুলে ধরেছিলেণ তাবারী সহ বিভিন্ন প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তার কিছু অংশ নিম্নরূপঃ১৯১
‘আমরা মদীনা থেকে বেদুইন ও সাধারণ মানুষের হাত থেকে কোন রকম পালিয়ে এসেছি। আমরা জনগণকে এমন অবস্থায় ছেড়ে এসেছি যে, তারা কিংবর্তব্যবিমূঢ়। তারা যেমন সত্যকেচিনতে পারছে না, তেমনি মিথ্যাকেও অস্বীকার করতে সক্ষম হচ্ছে না। নিজেদেরকে রক্ষাও করতে পারছেনা।’
হযরত আয়িশা (রা) বললেন, এখন আমাদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ করা উচিত। এ সময় তিন নিম্নের এ চরণটি আবৃত্তি করেনঃ
-যদি আমার কাওমের নেতারা আমার আনুগত্য করতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদেরকে এ বিপদ থেকে বাঁচাতে পারতাম।
তিনি আবার মক্কায় ফিরে গেলেন। খলীফার শাহাদাতের খবর মক্কায় ছড়িয়ে পড়লৈ চতুর্দিক থেকে মানুষ কাছে ছুটে আসতে লাগলো। ‘উমরা বিনত আবদির রহমান থেকে বর্ণিত হয়েছে। সে সময় উম্মু মুমিনীন বলেনঃ১২৯ সেই কাওমের (সম্প্রদায় মত অন্য কোন কাওম নেই যারা নিম্নোক্ত আয়াতের হুকুমকে প্রত্যাখ্যান করেঃ১৯৩
-যদি মু’মিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা আলত্মাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দেবে এবং ইনসাফ করবে।
হজ্জের মওসুম ছিল। ঘোষনার সাথে সাথে হারাম শরীফ থেকের কয়েকশো মানুষ সাড়া দিল। আবদুল্লাহ ইবন আমের বসরা থেকে প্রচুর নগদ অর্থ নিয়ে এসে আয়িশার (রা) সাথে যোগ দিল। ই‘য়ালা ইবন মুনাইয়্যা ইয়ামন থেকে সাত শো উট ও ছয় লাখ দিরহাম এনে আয়িশার (রা) হাতে দিল।১৯৪ এই বাহিনী কোন দিকে যাত্রা করবে তা ঠিক করার জন্য হযরত আয়িশার (রা) আবাস গৃহে পরামর্শ বৈঠক বসালো। আয়িশার (রা) মত ছিল মদীনার দিকে যাত্রা করার। কারণ সাবায়ী ও বিদ্রোহীরা সেখানেই অবস্থান করছিল। সেদিন তাঁর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ইসলামী উম্মার ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। কিন্তু তাঁরা এই সদ্ধান্তে আসেন যে, উসমানের (রা) রক্তের বদলা গ্রহণের জন্য বসরা ও কূফা থেকে-যেখানে হরত তালহা ও যুবাইরের (রা) প্রচুল সমর্থক ছিল, সামরিক সাহায্য নেওয়া হবে। অতঃপর এই কাফেলা মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) তখন মক্কায়। তাঁকেও বসরার দিকে যাওয়ার অনুরোধ করা হলো। আমি মদীনার মানুষ, মদীনাবাসীরা যা করে, আমি তাই করবো’-একথা বলে তিনি এই কাফেলার সাথেবসরার দিকে চরতে অস্বীকৃতি জানালেন। অন্যান্য উম্মাহতুল মুমিনীন-যাঁরা আয়িশার (া) সাথে মদীনায় ফেরার প্রস্ত্ততি নিয়েছিলেন, কেউ এই কাফেলার সাথে বসরার দিকে গেলেন না। একমাত্র হাফসা (রা) যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) বারণ করায় তিনিও আর গেলেন না। তবে অন্যান্য উম্মাহাতুল মুমিনীন ও মক্কার সাধারণ মানুষ ‘জাতুল ইরাক’ পর্যন্ত বসরাগামী কাফেলাকে এগিয়ে দেন। তাঁরা সেদিন ইসলামের এমন দুর্দিন দেখে এমন কান্নাকাটি ও মাতাম করেছিলেন যে আর কোনদিন তেমন দেখা যায়নি। এ কারণে ইতিহাসে এ দিনটিকে ইয়াউমুন নাহীব’ বা কান্নার দিন বলা হয়।১৯৫ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা) একটি উটের উপর সাওয়ার হয়ে কাফেলার সাথে বসরার দিকে চললেন। ইতিহাসের এক মন্তবড় ট্রাজেডির সাক্ষী এই উটের একটু পরিচয় দেওয়া এখানে অগ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। উিটটি উম্মুল মুমিনীনকে কে দিয়েছিল, সে সম্পর্কে দুই ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। ই‘য়ালা ইবন মুনাইয়্যা আশি দীনার দিয়ে খরিদ করে তাঁকে দেন। উটটির নাম ছিল আল-আসকার’। মতান্তরে উটটি ছিল উরাইনা’ গোত্রের এক ব্যক্তির। উরায়নী গোত্রের সেই লোকটি বর্ণনা করেছেঃ১৯৬ আমি একটি উটে চড়ে চলছি। এমন সময় এক অশ্বারোহী এসে আমাকে বললোঃ তুমি কি তোমার এ উটটি বেচবে? বললামঃ হ্যাঁ বেচতে পারি। লোকটি বললোঃ কত দাম? বললামঃ এক হাজার দিরহমা। বললোঃ তুমি কি পাগল? বললামঃ কেন? আল্লাহর কসম! এর উপর সোয়ার হয়ে আমি যাকেই ধরতে চেয়েছি, সফল হয়েছি। আর এই পিঠে থাকা অবস্থায় কেউ আমাকে ধরতে পারেনি। সে বললোঃ তুমি যদিজানতে, উটটি আমি কার জন্য কিনতে চাই। এটা আমি বিনতে চাই উম্মুূল মু’মিনীন আয়িশার (রা) জন্য। বললামঃ তাহলে আমি বিনা মূল্যেই দিলাম। সে বললোঃ তা হয় না, তুমি বরং আমার সাথে কাফেলার কাছে চলো, আমরা তোমাকে একটি মাদী উট ও অনেক দিরহাম দিব। আমি তার সাথে কাফেলার কাছে গেলাম। তারা আমাকে বিনিময়ে একটি মাদী উট ও চার মতান্তরে ছয় শো দিরহমা দিল।’ এই উরানী লোকটিকে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাফেলার সাথে নেওয়া হয়।
কাফেলার যাত্রাপথে মানুষ যখন শুনতে পেল, এই বাহিনীর পুরোধা উম্মুল মুমিনীন, তখন বহু লোক অত্যন্ত আবেগ ও উৎসাহের সাথে যোগদান করলো। এভাবে এক মানযিল পথ অতিক্রম করতেনা করতে তিন হাজারের একটি বাহিনী তৈরি হয়ে গেল। হযরত উসমানের (রা) গোত্র বনু উমাইয়্যার যুবকদের ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কি হতো পারতো? সে সময়ের পরিস্থিতি তাদের এত প্রতিকূল ছিল যে, চতুর্দিক থেকে তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে মক্কায় এসে বড় হচ্ছিল। হযরত আয়িশার (রা) ঘোষণা ছিল তাদের জন্য এক মহা সুযোগ। তারা সকলে তাঁর বাহিনীর মধ্যে ঢুকে গেল।
বনু উমাইয়্যার ইবনুল ‘আস ও মারওয়ান ইবনুল হাকামও কাফেলার সাথে বের হলেন। মারুজ জাহরান’ মতান্তরে ‘জাতু ইরাক’ পৌঁছে সা‘ঈদ ইবনুল ‘আস তাঁর দলীয় লোকদের বললেনঃ ‘তোমরা যদি উসমান (রা) হত্যার বদলা নিতে চাও তাহলে আগে এই লোকদের হত্যা কর। তাঁর ইঙ্গিত ছিল তালহা, যুবাইর, প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতি। কারণ বনু উমাইয়্যাদের মধ্যে সাধারণভাবে এ ধারণা প্রচলিত ছিল যে, উসমানের (রা) হত্যাকারী কেবল তারাই নয় যারা তাঁকে হত্যা করেছে অথবা তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বাইরে থেকে এসেছে, বরং ঐ সকল ব্যক্তির সকলে তাঁর সত্যাকারীদের মধ্যে পরিগণিত যাঁরা বিভিন্ন সময়ে হযরত উসমানের (রা) কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করেছেন এবং তারাও যাঁরা হাঙ্গামার সময় মদীনায় ছিলেন, কিন্তু তাঁকে রক্ষার জন্য যুদ্ধকরেননি। মাওয়ান বললেনঃ আমরা তাঁদের (তালহা, যুবাইর ও আলী রা.) একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়াবো। যাঁর পরাজয় হবে, তিনি এমনিই শেষ হয়ে যাবেন। আর যিনি জয়ী হবেন, এত দুর্বল হয়ে পড়বেন যে, অতি সহজেই আমরা তাঁকে কাবু করে ফেলতে পারবো।’১৯৭
আসলে বনু উমাইয়্যাদের আসল উদ্দেশ্যে ছিল হযরত আয়িশার (রাঃ) আপোষ-মীমাংসার আহবান ও আন্তরিক চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া। শুধু তাই নয়, আয়িশার (রা) নেতৃত্বে তৃতীয় আরেকটি শক্তির উত্থান হচ্চে দেখে তাদের অনেকে এই বাহিনীর মধ্যে নানা ভাবে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। তারা প্রশ্ন তোলে আলীকে (রা) পরাভূত করার পর তালহা ও যুবাইরের মধ্যে কে খলীফা হবেন? হযরত আয়িশা (রা) জানতে পেরে এ প্রপাগান্ডা থামিয়ে দেন। তারপর আরেকটি প্রশ্ন তোলা হয়-খিরাফতের ফায়সাপলা না হয় পরে হবে, কিন্তু এ মুহূর্তে নামাযের ইমাম হবেন কে? হযরত আয়িমা (রাঃ) তাহলা ও যুবাইরের (রা) ছেলেদের নামাযের ইমামতির জন্য একদিন করে নির্ধারণ করে দিয়ে এ ফিতনাও থামিয়ে দেন।
চরার পথে হাওয়াব’১৯৮ নামক জলাশয়ের নিকট পৌঁছলে এই বিশাল কাফেলা দেখে সেখানকার কুকুর হাঁকডাক আরম্ভ করে দেয়। ‘আয়িশা (রা) জিজ্ঞেস করেন স্থানটির নাম কি? বলা হলো, ‘হাওয়াব’। তখন তাঁর স্মরণ হয় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি বাণী, একবার তিনি বেগমদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ আল্লাহ জানেন তোমাদের মধ্যে কাকে দেখে হাওয়াবের’ কুকুরগুলি ডাকবে।’ এই ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ কহতেই হযরত আয়িশা (রাঃ) ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই ভবিষ্যদ্বাণস্মিরণ হতেই আয়িমা (রাঃ) ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন একরাত কাফেলা এখানে থেকে থাকে।১৯৯ অবশেষে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্য থেকে পঞ্চাশ ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, এটা হাওয়াব নয়। তখন তিনি নিশ্চিন্ত হন। তাছাড়া হযরত যুবাইর তখন বলেনঃ আপনি ফিরে যাবেন। কিন্তু হতে পারে আল্লাহ তা‘য়ালা আপনার দ্বারা এই বিবাদ মীমাংসা করে দেবেন।২০০ কোন কোন বর্ণনায় কথাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ তার (‘আয়িশার (রা.) সঙ্গীদের কেউ কেউ বললেন, পিছনে না ফিরে সামনে অগ্রসর হোন। লোকেরা যখন আপনাকে দেখতে পাবে তখন আল্লাহ তাদের মধ্যে একটা মীমাংসা করে দেবেন। সামনে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্থ অবস্থায় আছেন, তখন তাঁকে বলা হলো, আপনি দ্রুত চলুন, পিছন থেকে আলীর (রা) বাহিনী আসছে। এ সকল বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় হযরত আয়িশার (রা) বসরার দিকে চলার উদ্দেশ্য ছিল কেবল ইসলাম ও মীমাংসা।----==----
# == # কূফাঃ
মক্কা মু‘য়াজ্জামা, মদীনা মুনাওয়ারা ও বসরার পরে আরবের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল কূফা। হযরত আবু মূসা আল আশ‘য়ারী (রা) ছিলেন তথাকার ওয়ালী। উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে নিজেরদর দাবীর যৌক্তিকতা তুলে ধরে তার সমর্থন কামনা করছিল। মহান সাহাবী হযরত আবু মূসা (রা) এই বিবাদের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে নিজের প্রভাবের দ্বারা ও খুতবার মাধ্যমে এর থেকে দূরে থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানালেন। হযরত আয়িশা (রা) কূফার নেতৃবৃন্দের নামে পৃথক পৃথক চিঠি পাঠালেন। এদিকে হযরত আলীর (রা) পক্ষ থেকে হযরত আম্মার ইবন হয়াসির ও ইমাম আল-হাসান (রা) কূফায় পৌঁছলেন। হযরত আম্মার কূফার জামে‘ মসজিদে প্রদত্ত এক ভাষণে তৎকালীন ঘটনাবলী স্পষ্টভাবে তুলে দরেন। সেই ভাষণে তিনি হযরত আয়িশার (রা) সম্মান ও মর্যাদা বর্ণনার পরে বলেন, এ সব কিছু সঠিক। কিন্তু আল্লাহ ও ব্যাপারে তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছেন। আম্মারের (রা) এ ভাষণ কূফাবাসীদের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। কয়েক হাজার মুসলমান তাঁর আবেদনে সা দেন। তা সত্ত্বেও কূফাবাসীর মনে এই দ্ভিধা ও সংকোচ কাজ করতে থাকে যে, একদিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেগম উম্মুল মুমিনীন, আর অন্যদিকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যার স্বামী এবং চাচাতো ভাই-এই দুই জনের কার সাথে যাওয়া যেতে পারে।
এই দিকে হযরত আয়িশা (রা) বসরার সন্নিকটে পৌঁছে লোক মারফত শহরের আরব নেতৃবৃন্দের প্রত্যেকের নিকট চিঠি পাঠালেন। পরে বসরা পৌঁছে কোন কোন নেতার গৃহেও গেলেন। শহরের একজন নেতা তাঁর আহবানে সাড়া দিচ্ছিলেন না। তিনিনিজে তাঁর গৃহে যেয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। সে বললোঃ ‘আমার মায়ের কথা না মানতে পেরে আমার লজ্জা হচ্ছে।’২০১
হযরত আলীর (রাঃ) পক্ষ থেকে তখন বসরার ওয়ালী ছিলেন ‘উসমান ইবন হুনাইফ। তিনি প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য ইমরান ইবন হুসাইন ও আবুল আসওয়াদকে পাঠালন। তাঁরা হযরত আয়িশার (রা) নিকট উপস্থিত হয়ে ওয়ারীল পক্ষ থেকে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চান। আয়িশা (রা) তাঁদেরকে বলেন, ‘আল্লাহ কসম’ আমার মত ব্যক্তিরা কোন কথা গোপন রেখে ঘর থেকে বের হতে পারে না। আর না কোন মা প্রকৃত ঘটনা তার সন্তানদের কাছে লুকাতে পারে।’ তারপর তিনি তারে সামনে মদীনার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন এবং উসমান (রা) হত্যাকারীদের শাস্তিদান ও উম্মাতের মধ্যে যে দ্বন্দ-সংঘাত দেখা দিয়েছে তা মিটিয়ে ফেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সব শেষে তিনি বলেনঃ২০২ ‘তোমাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করা এবং খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা আমার কাজ।’ তারপর তিনি পাঠ করেনঃ২০৩
-তাদের অধিকাংশ সলা-পরামর্শ ভালো নয়; কিন্তু যে সলা-পরামর্শ দান-খয়রাত করতে কিংবা সৎকাজ করতে কিংবা মানুষের মধ্যে সন্ধিস্তাপন কল্পে করতো, তা স্বতন্ত্র।
এই দুই ব্যক্তি হযরত আয়িশার (রা) নিকট থেকে উঠে হযরত তালহা ও যুবাইরের (রা) কাছে যান। তাঁদের থেকেবিদায় নিয়ে আবার হযরত আয়িশার (রা) নিকট যান। তখন তিনি বলেনঃ আবুল আসওয়াদ, তোমার প্রবৃত্তি যেন তোমাকে দোযখের দিকে নিয়ে না যায়। তারপর তাদেরকে এ আয়াতটি পাঠ করে শোনানঃ২০৪
‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে।
‘আয়িশার (রা) বক্তব্যের প্রভাব এই হলো যে, প্রতিনিধিদ্বয়ের একজন সদস্য-ইমরান নিজেকে এই বিবাদ থেকে দূরে সারিয়ে নিলেন এবং বসরার ওয়ালীকেও তাঁর মত করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি বিরত হলেন না; বরং সবরায় হযরত আলীর (রা) পক্ষে জনমত সৃষ্টি চেষ্ট চালিয়ে যেতে লাগলেন। এদিকে তাহলা, যুবাইর ও আয়িশা (রা) বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমে বসরার জনগণকে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানাতে থাকলেন। একদিন এক সমাবেশে তাহলা ও যুবাইর (রাঃ) বক্তৃতা করার পর শ্রোতাদের মধ্যে দ্বিধা-সংশয় লক্ষ্য করে হযরত আয়িশা (রা) অত্যন্ত ধীরস্থীর ও গম্ভীর গলায় হামদ ও না‘ত পেশ করার পর নিম্নোক্ত ভাষণটি দান করেনঃ২০৫
‘জনগণ উসমানের (রা) কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতো, তাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দোষ-ত্রুটি প্রচার করতো। মানুষ মদীনায় এসে আমাদের কাছে পরামর্শ ও উপদেশ চাইতো। আমরা তাদেরকে সন্ধি ও আপোষ-মীমাংসার যে উপদেশ দিতাম তা মেনে নিত। উসমানের (রা) বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ ছিল, আমরা সে বিষয়ে গভীরভাবে খতিয়ে দেখে তাঁকে একজন নিষ্পাপ পরহেযগার ও সত্যবাদী ব্যক্তি হিসেবে পেতাম। আর শোরগোলকারীদেরকে দেখতাম তারা পাপাচারী ও ধোঁকাবাজ। তাদের অন্তরে ছিল এক কথা, আর মুখে ভিন্ন কথা। তাদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেল তখন তারা বিনা কারণে এবং বিনা দোষে উসমানের (রা) গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অতঃপর যে রক্ত প্রবাহিত করা বৈধ ছিল না, তা তারা করেছে, যে ধন-সম্পদ লুটপাট করা সঙ্গত ছিল না, তা করেছে, আর যে পবিত্র ভূমির মর্যাদা রক্ষা করা তাদের উপর ফরয ছিল, তারা তার অমর্যাদা ও অসম্মান করেছে। সাবধান! এখন যে কাজ করতে হবে এবং যার বিরোধিতা করা উচিত হবে না, তাহলো ‘উসমানের (রা) হত্যাকারীদের প্রেফতার করা এবং শক্তভাবে আল্লাহর হুকুম ও বিধান বলবৎ করা। আল্লাহ বলেছেনঃ২০৬
-আপনি কি তাদের দেখেছেন, যারা কিতাবের কিছু অংশ পেয়েছে-আল্লাহর কিতাবের প্রতি তারে আহবান করা হয়েছিলো যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা যায়। অতঃপর তাদের মধ্যে একদল তা অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ইবন আবদি রাবিবহি আল-আন্দালুসী হযরত আয়িশার (রা) এ সময়ের একটি ভাষণ তাঁর গ্রন্থে সংকলন করেছেন, যা ভাষা ও বাকশৈলীর দিক দিয়ে অতি চমৎকার। এখানে তাঁর অনুবাদ দেওয়া হলোঃ২০৭
‘ওহে জনমন্ডলী! চুপ করুন! চুপ করুন! আপনাদের উপর আমার মায়ের দাবী আছে। আপনাদেরকে উপদেশ দানেরও অধিকার আমার আছে। একমাত্র খোদা-দ্যোহী মানুষ ছাড়া কেউ আমার প্রতি কোন প্রকার দোষারোপ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বুকে মাথা রেখে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আমি তাঁর প্রিয়তমা বেগমদের অন্যতম। আল্লাহ পাক অন্য মানুষ থেকে আমাকে র্বভাবে সংরক্ষণ করেছেন। আমার সত্তা দ্বারা মুমিন ও মুনাফিকের পরিচয় নির্ণিত হয়েছে এবং আমাকে উপলক্ষ্য করে আল্লাহ আপনাদের জন্য তায়াম্মুমের বিধান দান করেছেন।
আমার পিতা এ পৃথিবীর তৃতীয় মুসলমান এবং ছাওর পর্বতের গুহায় দুইজনের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় এবং তাঁর গলায় খিলাফতের মালা পরিয়ে ইনতিকাল করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পর যখন ইসলামের রশি দুলতে থাকে তখন আমার পিতাই তা শক্ত হাতে মুট করে ধরেন। তিনিই নিফাক (কপটতা)থ-এর লাগাম টেনে ধরে, ধর্মত্যাগের ঝর্ণা ঘুকিয়ে ফেলেন, এবং ইহুদীদের আগুণে ফুঁ দেওয়া বন্ধ করে দেন। আমরা সেই সময় চোখ বন্ধ করে ধোঁকাবাজি, বিশ্বাসহীনতা ও ফিতনা-ফাসাদের প্রতীক্ষায় ছিলাম। …হ্যাঁ, এখন আমি মানুষের প্রশ্নের লক্ষ্রবস্ত্ততে পরিণত হয়েছি। কারণ, আমি বাহিনী নিয়ে বের হয়েছি। আমার এ বের হওয়ার উদ্দেশ্য পাপ ও ফিতনার অনুসন্ধান নয়-যা আমি নিশ্চিহ্ন করতে চাই, যা কিছু আমি বলছি সত্য ও ন্যায়ের সাথে বলছি। আমার ওজর-আপত্তি তুলে ধরা এবং আপনাদেরকে জ্ঞাত করানোর জন্য বলছি। আল্লাহ পাক নবী মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর দরূদ ও সালাম নাযিল করুন।’
জনগণ নীরবে মনোযোগ সহকারে তাঁর ভাষণ শুনছিল। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ প্রতিপক্ষের লোকদের অন্তরেও তীরের ফলার মত গেঁথে যাচ্ছিল। তাদেরানেকে স্বপক্ষ ত্যাগ করে আয়িশার (রা) সেনাক্যাম্পে এসে যোগ দেয়।
বসরায় পেঁছে হযরত আয়িশা (রা) কূফার ওয়ারী এবং কূফা ও বসরার আশে পাশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিকট তাঁর এভাবে আগমনের উদ্দেশ্যে ও তাদের করণীয় কর্তব্য বর্ণনা করে চিঠি লেখেন। উল্লেখ্য যে, ‘আললী (রা) ও আয়িশা (রা) চূড়ান্ত পর্যায়েরর মুখোমুখি-যাকে উটের যুদ্ধ বলা হয়-হওয়ার আগে উভয় পক্ষের লোকদের ম¨্য ছোটখাট অনেক সংঘর্ষ হয় এবং তাতে বহু লোক হতাহত হয়। অবশেষে বসরায় আয়িশার (রা) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ দিকে হযরত আপলী (রা) হযরত মু‘য়াবিয়াকে (রাঃ) নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মদীনা থেকে সিরিয়া যাত্রার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। এমন সময় বসরার এই সমাবেশের কথা অবগত হয়ে এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করার জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্র হলেন। কিন্তু বহু সংখ্যক সাহাবী এবং তাদেরানুগামী লোকেরা যারা মুসলমানদের এই গৃহযুদ্ধকেএকটি ফিতনা বা পরীক্ষা বলে মনে করছিলেন, এ যাত্রায় আলীর (রা) সহগামী হতে রাজি হলেন না।২০৮ হিজরী ৩৬ সনের রবী‘উস সানী মাসে হযরত আলী (রা) মদীনা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন।২০৯ সেদিন বহু সাহাবীর আলীর (রা) পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করার ফল এই হলো যে, সেই উসমান (রা) হত্যাকারীরা-যাদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য আলী (রা) সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীর মধ্যে ঢুকে গেল। যা একদিকে যেমন তাঁর দুর্নামের কারণ হয়ে দাঁড়ালো, তেমনি নানা সমস্যারও। বসরা শহরের অদূরে যেদিন উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) এবং আমীরুল মুমিনীন আলীর (রা) বাহিনীদ্বয় পরস্পর মুখোমুখি হন, সেদিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি সহানুভূতিশীল মানুলে বিরাট একটি দল আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালালেন ঈমানদার লোকদের এই দুইটি দলকে সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখার জন্য। তাঁদের চেষ্টায় আপোষ মীমাংসার কথাবার্তা পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলীর (রা) বাহিনীতে উসমান (রা) হত্যাকারীরা বিদ্যমান ছিল-যারা বুঝেছিল, যদি আপোষ-মীমাংসা হয়ে যায় তাহলে তাদের রক্ষা নেই,ান্যদিকে উম্মুল মুমিনীনের বাহিনীতে সেই লোকেরা ছিল, যারা দুইটি দলকে লড়িয়ে উভয়কে দুর্বল করে ফেলতে চাচ্ছিল। এ কারণে সৎ লোকেরা যে যুদ্ধটিকে ঠেকাতে আগ্রাণ চেষ্ট করেছিলেন, উভয় পক্ষের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে শেষ পর্যন্ত তা বাধিয়ে দিল এবং উটের যুদ্ধ হয়েই গেল।২১০----==----
# == # উটের যুদ্ধ -
হযরত আলী (রা) মদীনা থেকে মাত্র সাতশো লোক সংগে করে যাত্রা করেছিলেন। কূফা থেকে আরো সাতহাজার লোক যোগ দেয়। একটি ছোট্ট বাহিনী নিয়ে তিনি বসরায় পৌঁছেন। উভয় বাহিনী রণক্ষেত্রে মুখোমুখি হলো। আরবের প্রতিটি গোত্রের লোক সেদিন দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুদার গোত্রের এক ভাগ অন্য ভাগের সামনে দাঁড়ায়। এমনিভাবে আযদসহ অন্য সকল গোত্রও-একাংশ আরেক অংশের বিপক্ষে দাঁড়ায়। সত্যিই যে এস মর্মবিদারী দৃশ্য। সে দিন উবয় দলের, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রতিটি সদস্য ছিলেন সত্যের সিপাহী। প্রত্যেকে দূঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে তারা সত্যের উপর আছেন। কেউই নিজের অবস্থান থেকে বিন্দু মাত্র সরতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কুফার কোন কোন গোত্রের নেতারা তাদের স্বগোত্রীয় বসরী নেতাদের মসজিদে যান্ বেং তাঁদেরকে এই ঝগড়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার আহ্না জানান। কিন্তু তাঁরা জবাব দেয়ঃ আমরা কি উম্মুল মুমিনীনকে একাকী ছেড়ে দেব?
তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষের লোকদের দূঢ় বিশ্বাস ছিল, ব্যাপারটি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে না। একটা নিষ্পত্তি শেষ পর্যন্ত হয়ে যাবে। একজন গোত্রীয় নেতা হযরত আলীর (রা) নিকট যেয়ে একটা আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছার জন্য তাকিদ দিলেন। তিনি তো প্রথম থেকেই রাজি ছিলেন। আলীর (রা) নিকট থেকে উক্ত নেতা তালহা, যুবাইর ও মুমিনীন‘‘ এই কর্মকান্ডে আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি? বললেনঃ উসমানের (রা) হত্যকারীদের শাস্তি দান এবং আপোষ-মীমাংসার আহবান। গোত্রীয় নেতা বললেনঃ উম্মুল মুমিনীন! একটু ভেবে দেখুন তো, পাঁচ শো মানুষের শাস্তির জন্য পাঁচ হাজার মানুসের রক্ত ঝরিয়েছেন এবং পাঁচ হাজারের জন্য আপনাকে হাজার হাজার মানুষেল রক্ত ঝরাতে হবে। এ কেমন ইসলাহ ও সংশোধন হলো? লোকটির বক্তব্য এত স্পষ্ট ও মক্তিশালী ছিল যে, উম্মুল মুমিনীন নিরুত্তর হয়ে গেলেন। তিনি আপোষ করতে রাজি হলেন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্তে এসে গেলেন।২১১
এখন উভয় পক্ষ নিশ্চিন্ত। যুদ্ধ-বিগ্রহের চিন্তা তাদের অন্তর থেকে দূর হয়ে গেল। সবকিছু ঠিকঠাক মত নিষ্পাত্তির ব্যাপারে কারো কোন সনে্হদ থাকলো না। কিন্তু উবয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান দুস্পৃতিকারীরা দেখলো, যদি আপোষ-মীমাংসা হয়ে যায় তাহলে তাদের বিপদের অন্ত নেই। তাছাড়া তাদের বহু বছরের পরিকল্পনা ও চেষ্টা সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তারা তখন সক্রিয় হয়ে উঠলো। সাবায়ী দলের বিরাট একটি সংখ্যা আলীর (রা) পক্ষে ছিল। আলাপ-আলোচনার পর উভয় দলের রোকেরা যখন রাতের শেষ প্রহরে ঘুমিয়ে ছিল তখন এই সাবায়ীরা আক্রমণ করে বসলো। এই কিছু সংখ্যক পাপাত্মা হঠাৎ করে চতুর্দিকে আগুন জ্বালিয়ে দিল। ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে প্রত্যেকে নিজের অস্ত্রটি হাতে তুলে নিল। প্রত্যেক গ্রুপ ও দলের নেতারা বিশ্বাস করলো, প্রতিপক্ষ তাদের নিদ্রার সুযোগে চুক্তি ভঙ্গ করে আক্রমণ করে বসেছে। হযরত আলী (রা) লোকদের থামাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।
সকাল পর্যন্ত এ হৈ হাঙ্গামা চলতে থাকে। হৈ চৈ হযরত আয়িশা (রা) জিজ্ঞেস করেনঃ কি হয়েছে? জানতে পারলেন, লোকেরা যুদ্ধ করে দিয়েছে। বসরার কাজী কা‘ব ইবন সুওয়ার হযরত আয়িশার (রা) নিকট এসে বললেন, আপনি উটের পিঠে চড়ে চলুন। হতে পারে লোকেরাপনার মাধ্যমে সন্ধি করে নেবে।২১২ তিনি লোহার লৈতরি হাওদা উটের পিঠে বেঁধে তাঁরম¨্য বসে সৈন্যবাহিনীর মাঝ বরাবর চলে আসেন। এদিকে হযরত আলী (রাঃ) তাঁর প্রতিপক্ষ হযরত তালহা ও হযরত যুবাইরকে ডেকে আনেন। এই তিন মহান সাহাবী ঘোড়ার উপর বসা অবস্থায় কিছুক্ষণ এক স্থানে অবস্থান করেন। বদর-উহুদের সহযোদ্ধাত্রয়ীর আজ এমন অবস্থান! সত্যি সে এক পীড়াদায়ক দৃশ্য। আলী (রা) তাঁদের দুইজনকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মরণকরিয়ে দেন। তাঁদেরও স্মারণ হলো। সাথে সাথে যুবাইর (রা) যুদ্ধের ইচ্ছা অন্তর থেকে মুছে ফেলেন। ছেলে ‘আবদুল্লাহ পাশেই ছিলেন। তিনি পিতাকে ভীরু, কাপুরুষ বলে তিরস্কার করেন। যুবাইর জবাব দেন, লোকেরা জানে আমি ভূীরু নই। তবে আলী (রা) আমাকে একটি কথা স্মারণ করে দিয়েছে, যা আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি। আশি শপথ করছি, তাঁর বিরুদ্ধে আমি আর লড়বো না।২১৩
তিনি ঘোড়ার লাগামে টান দিয়ে মুখ গুরিয়ে রণক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করেন। ইবন জুরমূয নামক এক সাবায়ী তাকে অনুসরণ করে এবং পথিমধ্যে সে নামাযে সিজদারত অবস্থায় তরবারির এক আঘাতে তাঁর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
হযরত তালহাও (রাঃ) রণক্ষেত্র থেকে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি উমাইয়্যা গোত্রের মারওয়ানের দৃষ্টিতে পড়ে যান। সে বুঝেছিল, যদি তালহা জীবিত ফেরে তাহলে উমাইয়্যা খান্দানের প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে। সে তাঁকে তাক করে একটি বিষাক্ত তীর ছোড়ে। তীরটি তাঁর পায়ে বেধে। কোনভাবেই রক্ত পড়া বন্ধ করা গেল না। এই আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এদিকে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা) কা‘ব ইবন সুওয়ারকে ডেকে তাঁর হাতে নিজের কুরআনের কপিটি দিয়ে বলেন, যাও এটি দেখিয়ে মানুষকে আপোষ-মীমাংসার আহবান জানাও। তিনি কুরআনখুলে উভয় দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। দৃষ্কৃতিকারীরা দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ে। ফলে তিনিও শাহাদাত বরণ করেন।
দুপুর হয়ে গেল। আক্রমণ ছির অতর্কিত। হযরত আয়িশার (রা) বাহিনীর অধিনায়করা শেষ পর্যন্ত এই ফিতনা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিলেন। এ কারণে তাঁর বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লো। এই যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, উভয় পক্ষের গরিষ্ঠ অংশের বিশ্বাস ছিল, প্রতিপক্ষ আমাদের মুসলিম ভাই। এ কারণে, প্রত্যেকে তার প্রতিপক্ষের হাত পা বা অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত করার চেষ্টা করছিল। সবাই চেষ্টা করছিল যাতে মাথা ও বুকে আঘাত না লাগে। উদ্দেশ্য; হাত-পা কাটা গেলেও যাতে জীবনে বেঁচে থাকে। তারা আন্তরিকভাবে কামনা করছিল, যুদ্ধ বন্ধু হোক। রণক্ষেত্রের বিভিন্ন স্থানে নৈকিদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হাত-পায়ের স্তহপ হয়ে গিয়েছিল।
সাবায়ীদের বাসনা ছিল, আয়িশাকে (রাঃ) হাতের মুঠোয় পেলে চরমভাবে অবমাননা করা হবে। সুতরাং হযরত তালহা ও যুবাইরের (রা) শাহাদাতের পর কূফাবাসীরা তাঁর উপর আক্রমণের লক্ষ্যে এগিয়ে আসে।২১৪ হযরত আয়িশার (রা) বাহিনীর লোকেরাও চতুর্দিক থেকে গুটিয়ে যায়। উম্মুল মুমিনীনের উটটি একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল। চতুর্দিক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর-বর্শা এসে আঘাত করছিল তাঁর বর্ম আচ্ছাদিত হাওদায়। সন্তানেরা ডানে-বামে সাম–পিছন থেকে আক্রমণ প্রতিহত করে চলচিল। তখন তাদের অনেকের মুখেএ দুইট চরণ উচ্চরিত হচ্ছিল।২১৫
-হে আমাদের মা, হে আমাদের সেই মা-যাঁকে আমরা সর্বোত্তম বলে জানি! আপনি কি দেখছেন না, কত বীর সন্তানকে আহত করা হচ্ছে এবং তাদের হাত ও মাথা কাটা যাচ্ছে?
এখন চতুর্দিক থেকে এ আওযায় উঠতে লাগলো যে, যতক্ষণ না উম্মুল মুমিনীনের উটটি আঘাত করে বসিয়ে দেওয়া যাবে, এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হবে না। বনু দাববা উটের চতুর্দিকে একটা বেষ্টনী করে রেখেছিল। কেউ উটের দিকে এাগানোর চেষ্টা করলেই তাকে তারা জীবিত ছেড়ে দিচ্ছিল না। তারা তখন একটা আবেগ ও উত্তেজনাপূর্ণ সংগীত গেয়ে চলছিল। তার তিনটি শ্লোক নিম্নরূপঃ২১৬
-‘আমরা দাববার সন্তান, এই উটের রক্ষক। মৃত্যু আমাদের নিকট মধুর চেয়ে মিষ্টি।
-আমরা মৃত্যুর সন্তান-মৃত্যু যখন আসে। আমরা আফফানের ছেলে উসমানের মৃত্যুর ঘোষণা নিযার ফলার সাহায্যে করি।
-তোমরা আমাদের নেতাকে ফিরিয়ে দাও, তাহলে তোমাদের সাথে কোন দ্বন্দ্ব নেই।’
আবেগ ও উত্তেজনা এমন প্রবল ছিল যে, বনু দাববার একজন একজন করে এগিয়ে গিয়ে উটের লাগাম ধরছিল, প্রতিপক্ষের আঘাতে তার হাত বিচ্ছিন্ন হলে অন্য একজন ছুটে এসে লাগামটি মুঠ করে ধরছিল। এভাবে একই স্থানে উটের লাগাম ধরা অবস্থায় ৭০ (সত্তর) ব্যক্তির হাত বিচ্ছিন্ন হয়।২১৭ এমনিভাবে উম্মুল মুমিনীনের প্রতিপক্ষের যে কোন হাত সে দিন উটের লাগামের প্রতি বাড়ানো হয়েছিল, তা আর আস্ত ফিরিয়ে নিতে পারেনি। হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা) নিকটেই দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি বলেনঃ কর্তিতহাত যেন তখন বাতাসে উড়ছিল। এ দৃশ্য দেখে হযরত আলী (রা) ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসেন। আশতার আন-নাখ‘ঈ আবদুল্লাহ বিন যুবাইয়ের কাছে পৌঁছে গেলেন। দুইজনই ছিলেন সাহসী বীর পুরুষ। উভয়ের মধ্যে অসির যুদ্ধ শুরু হলো। দুইজন আহত হলেন। এ অবস্থায় একে আপরকে জড়িয়ে ধরলেন। ইবন যুবাইর (রা) চেঁচিয়ে বলে উঠলেনঃ২১৮
অর্থাৎ মালিক ও আমাকে মেরে ফেল। আমার সাথে মালিককেও হত্যা কর।
পরবর্তীকালে আশতার নাখ‘ঈ বলতেনঃ লোকেরা আমাকে মালিকনামে জানতো না, তাই সে দিন রক্ষা পেয়েছিলাম। অন্যথায় আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো।
বনু দাববার কিছু লোক আলীর (রা) পক্ষেও ছিলেন। তাঁরা দেখলেন উট যদি তাঁদের দৃষিট আড়ালে না আনা যায় তাহলে যেভাবে লোক মারা যাচ্ছে তাতে তাঁদের গোত্র নির্মূল হয়ে যাবে। এমন চিন্তা মাথায় আসার পর দাববা গোত্রের বুজাইর ইবন দালজা’ নামক এক ব্যক্তি পিছন দিক থেকে এসে উটের পায়ে তরবারিরর এমন আঘাত হানেন যে, উট হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ে। আর সাথে সাথে উটকে কেন্দ্র করে আয়িশার (রা) পক্ষে যাঁরা লড়ছিলেন তারা সরে গেলেন। আলীর (রা) কোন রক্ম আঘাত পেয়েছেন কিনা।হাত দেখেই আয়িশা (রা) গর্জে ওঠেনঃ এ কোন মালউনের (অভিশপ্ত) হাত? আয়িশঅ বলেনঃ না, তুমি মুহাম্মদ (প্রশংসিত) নও, তুমি মুজাম্মম (নিন্দিত)। অন্য একটি বর্ণনা মতে আয়িশা প্রশ্ন করেনঃ কে? মুহাম্মাদ বলেনঃ আপনার অনুগত ভাই। আয়িশা (রা) বলেনঃ তুমি অগুগত নও, বরংয় অবাধ্য। মুহাম্মদ প্রশ্ন করেনঃ বোন! আপনি কি কোন আঘাত পেয়েছেন? আয়িশা (রা) জবাব দেনঃ তাতে তোমার কি?
এরই মধ্যে হযতর আলী (রাঃ) উটের কাচে এসে হাজির হলেন। তিনি জানতে চাইলেনঃ আম্মা, আপনি কেমন আছেন? আয়িশা (রা) বললেনঃ ভালো আছি আলী (রা) বললেনঃ আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আয়িশা বললেনঃ আল্লাহ আপনাকেও ক্ষমা করুন। ২১৯
হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) কাছেই ছিলেন। তিনি বললেনঃ মা, আপনার সন্তনদের এ লড়াই কেমন দেখলেন? আয়িশা (রা) বললেনঃ আমি তোমার মা নই। আম্মার (রা) বললেনঃ আপনার পছন্দ না হলেও আপনি আমার মা। আয়িশা (রা) বললেনঃ বিজয়ী হয়েছো বলে গর্ব করছো। যেভাবে বদলা নিয়েছো তাই সংগে নিয়ে এসেছো। জেনে রাখ, যাদের আচরণ এমন হয় তারা কখনও বিজয়ী হতে পারে না।
হযরত আয়িমা (রা) বসরা থেকে সেজা মক্কা মুকাররামায় চলে যান। পরবর্তী হজ্জ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তারপর মদীনায় ফিরে যান এবং আজীবন সেখানে বসবাস করেন। পরিশুদ্ধির যে পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেন, সারা জীবনতার জন্য আফসোস করেছেন।২২৫ ইবন সা‘দ বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়িশা (রা) বলতেনঃ হায়, যদি আমি বৃক্ষ হতাম,! হায়, যদি আমি পাথর হতাম! হাং, যদি আমি কিছুই না হতাম।২২৬ একথা বলা দ্বারা তার আফসোসের পরিমণ অনুমান করা যায়।
একবার বসরার অধিবাসী এক ব্যক্তি আয়িশার (রা) সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। আয়িশা (রা) তাকে প্রশ্ন করেনঃ তুমি কি আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলে? লোকটি জবাব দিলঃ হাঁ। আয়িশা (রা) প্রশ্ন করেনঃ তুমি কি সেই ব্যক্তিকে চেন, যে সেদিন এইচ চরণটি আবৃত্তি করেছিল।:
লোকটি বললোঃ সে তো আমার ভাই। বর্ণনকারীর বলেছেন যে, তারপর হযরত আয়িশা (রাঃ) এত কাঁদলেন যে, আমার মনে হলো এ কান্না যেন আর থামবে না। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন, মৃত্যুর সময় তিনি অসীয়াত করেন যে, আমাকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের পাশে দাফন করবে না। বাকী‘ গোরস্থানে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে।২২৭ ইবন সা‘দ বর্ণনা করেছেন।অ আয়িশা (রা) মৃত্যুর সময় বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে একটি নতুন কাজ করেছি। সুতরাং তোমরা আমাকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে।২২৮ একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যখন আয়াত২২৯
(তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে) তিলাওয়াত করতেন তখন এত কাঁদতেন যে, চোখের পানিতে আঁচল ভিজে যেত।২৩০ উটের যুদ্ধের শেষ হওয়ার পর হযরত আয়িশা (রা) আল-কা‘কা ইবন আমরকে বলেছিলেনঃ আল্লাহর কসম! আমি যদি আজকের এ দিনটির আরো বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম, তাহলে কতনা ভালো হতো।’ আর সে কথা শুনে আলীও (রা) ঠিক একই রকম মন্তব্য করেছিলেন।২৩১
‘আইন ইবন দুরাইয়া আল-মাজাশি’ নামক এক ব্যক্তি এসে হাওদার মধ্যে ইক মারতে থাকে। ‘ধায়িশা (রা) বলেনঃ সরে যাও। তোমার উপর আল্লাহর অভিশাপ। লোকটি বলেঃ আমি শুধু হুমায়রাকে এক নজর দেখতে চাই। হযরত ‘ধায়িশা (রা) তখন লোকটির প্রতি অভিশাপ দিয়ে বলেনঃ ‘আল্লাহ তোমার আবরু-ইজ্জত উন্মুক্ত করুন, তোমার হাত বিচ্ছিন্ন করুন এবং তোমার লজ্জাস্থান প্রকাশ করুন’ পরে লোকটি বসরায় নিহত হয়। তার সকল জিনিসপত্র লুণ্ঠিত হয়ে। হাত-পা কর্তিত ও উলঙ্গ অবস্থায় আযদ গোত্রের এশটি বিরান ভূমিতে তার লাশটি পাওয়া যায়।২২০
হযরত ‘আলী (রা) মুহাম্মদ ইবন আবী বকরের নেতৃত্বে উম্মূল মুমিনীনকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে তাঁরই পক্ষাবলম্নকারী বসরার এক নেতা- ‘আবদুল্লাহ ইবন খালাফ আল-খুযা’ঈ-এর গৃহে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থ করেন। হযরত ‘আয়িশার (রা) বাহিনীর আহত সৈনিকরা সেই বাড়ির ঘর ও বাইরের প্রতিটি স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। অুঃপর হযরত ‘আলী (রা), হযরত ইবন ‘ধাববাস (রা) ও আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি উম্মুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাৎ করতে সেখানে যান। হযরত ‘আলী (রা) উম্মূল মুমিনীনকে সালাম করেন এবং কিছুক্ষণ তাঁর পাশে অবস্থান করেন। হযরত ‘আলী (রা) জানতেন যে, এই বাড়িতে প্রতিপক্ষের আহত সৈনিকরা আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কিন্তু তিনি সে বিষয়ে কোন কথাউচ্চারণরণ করলেন না।২২১
উম্মূল মুনিনীন কয়েকদিন বসরায় অবসত্মান করেন। তারপর হযরত ‘আলী (রা) যথাযোগ্য মর্যাদায় ও সম্মানের সাথে মুহাম্মদ ইবনে আবী বকরের (রা) তত্ত্বাবধানে চল্লিশজন সম্ভ্রামত্ম বসরী মহিলা সমভিব্যাহারে তাঁর হিজাযে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বারো হাজার দিরহামও সাথে দিয়ে দেন।২২২ হযরত ‘আলী (রা) সহ অসংখ্য সাধারণ মুসলামান বহুদূর পর্যমত্ম তাঁদেরকে এগিয়ে দেন। ইমাম হাসান (রা) বহু মাইল পথ সেই কাফেলার সাথে চলেন। হিজরী ৩৬ সনের ১লা রজব শনিবার উম্মূল মুমিনীর বসরা থেকে যাত্রা করেন।২২৩ যাত্রাকালে জনগণকে তিনি বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম, একজন নারীর তার জামাইদের সাথে যে রকম সম্পর্ক থাকে, তাছাড়া অন্য কোন বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক তাঁর (‘আলী) ও আমার মধ্যে অুীতে ছিল না। আমার জানা মতে তিনি সৎ লোকদের একজন।’ জবাবে ‘আলী (রা) বলেনঃ ‘ওহে জনমন্ডলী! তিনি সত্য বলেছেন। আমার ও তাঁর মাঝে কোন রেষারেষি নেই। তিনি আপনাদের নবীর স্ত্রী- দুনিয়া ও আখিরাতে।২২৪
হিজরী ৩৬ সনের ১০ই জামাদি-উস-সানী বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আসর পর্যমত্ম উটের যুদ্ধ হয়।২৩২ এ যুদ্ধে আহতের সংখ্যা অসণিত। নিহতের সংখ্যা কত, সে ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতভেদ আছে। ইবনুল ইমাম-আল-হাম্বালী তাঁর ‘শাজারাতুজ জাহাব’ গ্রন্থে তেত্রিশ জাহার, মহামত্মরে সতেরো হাজার উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনুল আসীরসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিক দশ হাজার উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে অর্ধেক আলীর (রা) ও অর্ধেক ‘আয়িশার (রা) পক্ষের। ইবনুল আসীর আরো উল্লেখ করেছেন’ একমাত্র বনু দাববার এক হাজার লোক নিহত হয় এবং উটের পাশেই শুধু বনী আদীর সত্তর (৭০) ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়।২৩৩ এই যুদ্ধে ইসলামের এমন অনেক বীর পুরুষ শাহাদাত বরণ করেন, যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে গড়ে তোলেন এবং যারা ছিলেন ইসলামের অতি পরীক্ষিত সমত্মান। তালাহ (রা), যুবাইর (রা) প্রমুখ তাঁদের অন্যতম। তাঁদের মৃত্যুতে মুসলিম উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল।
রণক্ষেত্রে হযরত ‘আয়িশার (রা) উট বসে যাওয়ার পর হযরত ‘আলী (রা) একজন ঘোষককে এই ঘোষণা দানের নির্দেশ দেনঃ ‘কেউ কোন পলায়ণাকারীকে ধাওয়া করবে না, কোন আহত সৈনিকের মালামাল লুট করবেনা এবং কোন সৈনিক কোন গৃহে প্রবেশ করবে। বিশেষতঃ নারীদের ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দেন এভাবেঃ২৩৪
-‘তোমরা অবশ্যই কারো ইজ্জ্ত-আবরু উন্মুক্ত করবেনা, কোন গৃহে প্রবেশ করবেনা, কোন নারীর উপর চড়াও হবে হবে না- যদিও সে তোমাদের মান-মর্যাদা, তোমাদের নেতা ও সৎ লোকদের নিয়ে উপহাস ও গালিগালাজ করে। নারীদের উপর হাত তুলতে (রাসূলুল্লাহর সা. সময়) আমাদেরকে নিষেধ করা হতো-যখন সেই নারীরা ছিল মুশরিক। তাহলে এখন এই মুসলিম নারীদের উপর হাত তোলা যায় কিভাবে?’
যুদ্ধ শেষে ‘আলী (রা) ময়দানে পড়ে থাকা লাশের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন এবং পরিচিত লাশের কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর পক্ষে তোক বা ‘আয়িশার (রা) পক্ষের-দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। তারপর উভয় পক্ষের সকল লাশ এক স্থানে জমা করার নির্দেশ দিলেন। তিনি ইমাম হয়ে সকলের যানাযার নামায পড়ালেন এবং বড় বড় কবর খুঁড়ে এক সাথে অনেকের দাফনের ব্যবস্থা করলেন। তিনি হযরত তালহা ইবন ‘উবাইদুল্লাহর (রা) লাশের কাছে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেনঃ
তারপর বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম! কোন কুরাইশকে এভাবে পড়ে থাকা আমি পছন্দ করতাম না।’ তারপর তিনি সৈনিকদের পরিত্যক্ত জিনিস সংগ্রহ করে বসরার মসজিদে জমা করার নির্দেশ দেন এবং ঘোষণা করেন যে, ‘শুধু অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া প্রত্যেকেই নিজ নিজ জিনিস সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারে। অস্ত্র-শস্ত্র কোষাগারে জমা হবে।’২৩৫
যুদ্ধের পর হযরত ‘আয়িশা (রা) উভয় দলের কে কে নিহত হয়েছে তা জানতে চাইতেন। যখন বলা হতো অমুক নিহত হয়েছে, বলতেন- (আল্লাহ তার প্রতি করুণা করুন)। এই যুদ্ধে নিহতদের সর্ম্পকে হযরত ‘আলী (রা) বলেতেনঃ ২৩৬
-‘আমি অবশ্যই আশা করি এই লোকদের মধ্যে যার অমত্মর আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ছিল তারা সবাই জান্নাতে যাবে।’
এখানে একটি বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার যে, কিছু বিকৃতমনা মানুষের ধারণা, উটের যুদ্ধের মূল কারণ হলো, ‘আলীর (রা) এশটি পুরানো ক্ষোভ ও বিদ্বেষ। ইফকের ঘঁনায় ‘আলী (রা) রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলে তাঁকে পরিত্যাগ করতে পারেন’। মঃূলতঃ তখন থেকেই হযরত ‘আয়িশা (রা) ‘আলীর (রা) প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর তারই পরিণতি এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কিন্তু আমাদের সামনে হাদীস ও ইতিহাসের যে সকল তথ্য রয়েছে, তাতে এমন ধারণা পোষণের কোন অবকাশ নেই। এাঁ সম্পূর্ণ অমূলক ধারণা। ইহিহাসে এমন বহু তথ্য রয়েছে যাতে বিপরীত চিত্রটিই ফুটে ওঠে। দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায় এখানে আমরা তা উল্লেখ করলাম না। ইতিহাসের সকল তথ্য পর্যালোচনা ষড়যন্ত্রকারী ছাড়া উভয় পক্ষের সকলেই ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাপরাধ। সংঘাত ও সংঘর্ষের করেননি। এক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছে।
হযরত ‘আলীর (রা) খিলাফতের সময়কাল ছিল মাত্র চার বছর। তারপর হযরত আমীর মু’য়াবিয়া (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী বিশ বছর যাবত
গোটা ইসলামী দুনিয়ার একক শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর খিলাফতকাল শেষ হওয়ার দুই বছর পূর্বে হযরত ‘আয়িশা (রা) ইনতিকাল করেন। হযরত মু’য়াবিয়ার (রা) শাসনকালে তিনি জীবনের আঠারোটি বছর অতিবাহিত করেন। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দীর্ঘ সময় সম্পূর্ণ নীরবে অতিবাহিত করেন।
একবার হযরত মু’য়াবিয়া (রা) মদীনায় আসেন এবং হযরত ‘আয়িশার (রা) সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। ‘আয়িশা (রা) তাঁকে বলেন, তুমি এমন নিশ্চিমত্ম মনে একাকী আমার ঘরে এসে গেলে? এও তো সম্ভব ছিল যে, আমি কোন ঘাতককে দাঁড় করিয়ে রাখতাম এবং তুমি ঢোকার সাথে সাথে তোমার কল্লা কেটে ফেলতো। আমীর মু‘য়াবিয়া (রা) বললেন, এটা দারুল আমান (নিরাপত্তার গৃহ), এখানে আপনি এমন কাজ করতে পারতেন না। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ঈমান অতর্কিত হত্যার শিকল। তারপর হযরত মু‘য়াবিয়া (রা) প্রশ্ন করেন,
Comments
Post a Comment