হযরত উম্মু হাবীবা (রাঃ)


উম্মুর মু’মিনীন হযরত উম্মু হাবীবা (রা) কুরাইশ নেতা হযরত আবু সুফইয়ানের (রা) কন্যা। ইসরাম পূর্ব মক্কার কুরাইশদের তিন ব্যক্তি-‘উতবা, আবু জাহল ও আবু সুফইয়ান খুব দাপটের নেতা ছিলেন। কুরাইশদের সামরিক ঝান্ডা ‘ইকাব’ আবু সুফইয়ানের কাছেই থাকতো। তিনি ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। শাম, রোম ও আজমে তিনি বাণিজ্য কাফেলা পাঠাতেন। মাঝে মাঝে কাফেলার সাথে তিনি নিজেও যেতেন। এই আবু সুফইয়ানের আসল নাম সাখর ইবন হারব।



আবু সুফইয়ানের এক কন্যা যায়নাব। তার বিয়ে হয় তায়েফের দাউদ ইবন ‘উরওয়া ইবন মাস‘উদ আসা-সাকাফীর সাথে। অপর দুই কন্যার বিয়ে হয় উম্মুল মু’মিনীন হযরত যায়নাব বিনত জাহাশের (রা) দুই ভাইয়ের সাথে। ফারি‘আকে আবু আহমাদ ইবন জাহাশ এবং উমুম হাবীবাকে উবাইদুল্লাহ ইবন জাহাশ বিয়ে করেন। আবু সুফইয়ানের এক পুত্র হযরত মু‘আবিয়া ৯লা)। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীল (রা) সাথে যার সংঘা ও সংঘর্ষ হয়। এই মু‘আবিয়ার (রা) পুত্র ইয়াযীদ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাতি হযরত ইমাম হুসাইনকে (রা) কারবালায় শহীদ করেন। মু‘আবিয়া (রা) উমাইয়্যা খিলাফতের প্রতিষ্টা করেন।



আবু সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনত ‘উতবা উহুদের প্রান্তরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচা হযরত হামযার (রা) কলিজা চিবিয়েছিলেন। হিন্দা ছিলেন হযরত মু‘আবিয়ার (রা) মা। আবু সুফইয়ানের অন্য এক স্ত্রী সাফিয়্যা বিনত আবীল আস উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু হাবীবার (রা) মা। মু‘আবিয়া (রা) উম্মু হাবীবার (রা) সৎ ভাই। উম্মু হাবীবার (রা) মা সাফিয়্যা ছিলেন তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান ইবন আফফানের (রা) ফুফু। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির সতেরো বছর পূর্বে উম্মু হাবীবা (রা) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।



আবু সুফইয়ান, তাঁর স্ত্রী হিন্দা ও তাঁর খান্দানের অধিকাংশ মানুষ মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হন। কিন্তু তখনও আবু সুফইয়ান প্রকৃত মুসরমান হতে পারেননি। তিনি তখন মুয়াল্লাফাতুল কুলূব’-এর অন্তর্গত। কোন কোন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন যে, পরে তিনি একজন ভালো মুসলমান হয়ে যান।



পিতৃ-পরিবার ইসলামের প্রতি মক্কা বিজয় পর্যন্ত বিদ্বেষী থাকলেও উম্মু হাবীবা (রা) ও ফারি‘আ (রা) এর স্বামীর পরিবার কিনউ ইসলামের সূচনা পর্বেই মুসলমান হয়ে যায়। তাঁরাও তাঁদের স্বামীদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।



হযরত উম্মু হাবীবা (রা) স্বামী ‘উবাইদুল্লাহ ইবন জাহাশসহ মক্কার কাফিরদের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য হাবশায় হিজরাত করেন। এই হাবশার মাটিতে উবাইদুল্লাহর ঐরসে কন্যা হাবীবার জন্ম হয়। তবে ইবন সা‘দ আল-ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, হাবশায় হিজরাতের পূর্বে মক্কায় ‘হাবীবা’র জন্ম হয়। আর এই কন্যার নামে তাঁর উপনাম হয় ‘উম্মু হাবীবা’। তাঁর আসর নাম ‘রামলা’ হারিয়ে যায় এবং এই উপনামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।



হাবশায় যাওয়ার কিছুদিন পর স্বামী ‘উবাইদুল্লাহ ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। তর ধর্মত্যাগের পূর্বে হযরত উম্মু হাবীবা (রা) একবর স্বপ্নে স্বামীকে বিভৎসরূপে দেখেন। তিনি ভীত-শংকিত হয়ে আপন মনেবরেন, নিশ্চয় তার কোন খারাপ পরিণতি হতে যাচ্ছে। সকাল বেলা ‘উবাইদুল্লাহতাঁকে বললোঃ ‘উম্মু হাবীবা! আমি ধর্মের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি। ক্রিস্টধর্ম থেকে অন্য কোন ধর্ম আমি ধর্মের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি। খ্রিস্টধর্ম থেকে অন্য কোন ধর্ম বেশি ভারো বলে মনে হয়নি। যদিও আমি মুসলমান হয়েছি, তবে এখন আমি খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছি। হযরত উম্মু হাবীবা (রা) স্বামীর এহেন পথভ্রষ্ঠতায় যথেষ্ট তিরস্কার কররেন এবং নিজের স্বপ্নের কথাও তাকে বললেন। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হলো না। সে খ্রিস্টান থেকেই গেল। এভাবে তাঁদের মধ্রে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। উবাইদুল্লাহ এখন বেপরোয়াভাবে জীবন যাপন করতে আরম্ভ করলো। একদিন অতিরিক্ত মদ পানাবস্থায় পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। মতান্তরে মদ্যপ অবস্তায় সাগরে ডুবে মারা যায়।৭ উম্মু হাবীবা (রা) আরও বরেছেন, আমি দেখলাম, কেউ আমাকে ইয়া উম্মাল মু‘মিনীন’-বলে ডাকছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি এর ব্যাখ্রা কররাম যে, রাসূরুলত্মাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বিয়ে করবেন।



ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর হযরত উম্মু হাবীবা (রা) কন্যা হাবীবাকে নিয়ে হাবশায় বসবাস করতে থাকেন। এ খবর মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানে পৌঁছলো। উম্মু হাবীবার (রা) ইদ্দাত পূর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনা তেকে আমর ইবন উমাইয়্যা আদ-দামরীকে (রা) একটি চিঠি এবং চার শো দীনার দেন-মাহরের অর্থসহ হাবশার সম্রাট নাজ্জাশীর নিকট পাঠান। চিঠিতে তিনি নাজ্জাশীকে লেখেন-‘আমার সাথেই উম্মু হাবীবার বিয়ের কাজ কমাধা করে দাও।’ চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নাজ্জাশী তাঁর দাসী আবরাহাকে উম্মু হাবীবার নিকট পাঠিয়ে বিয়ের পয়গাম পৌঁছে দেন। তাঁকে একথাও জানান যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য আমাকে লিখেছেন। এখন এ অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য আপনি আপনার পক্ষের একজন উকিল মনোনীত করুন। হযরতু্ম্মু হাবীবা (রা) এ সুসংবাদ দানের জন্য আবরাহাকে নিজের দুইটি রূপোর চুড়ি, কানের দুল ও একটি নকশা করা আংটি দান করেন। আর মাতাতো ভাই খালিদ ইবন সা‘ঈদ ইবন আবীল ‘আসকে উকিল নিয়োগ করে নাজ্জাশীর নিকট পাঠান।



সন্ধ্যার সময় নাজ্জাশী হাবশায় সববাসরত হযরত জা‘ফর ইবন আবী তালিব (রা) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামকে (রা) দরবারে ডেকে পাঠান এবং তাঁদের সবার উপিস্থিতিতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। নাজ্জাশী নিজেই বিয়ের খুতবা পাঠ করেন এবং চার শো দীনার মাহরের অর্থ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পক্ষ থেকে খালিদ ইবন সা‘ঈদের হাতে তুরে দেন। অনুস্ঠান শেষে সবাই যখন উঠার প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন তখন খারিদ ইবন সা‘ঈদ সবাইকে থামিয়ে বররেন, নবীদের (রা) সুন্নাত বা রীতি হচ্ছে বিয়ের পর আহার করানো। তারপর তিনি সকলকে আহার করিয়ে বিদায় দেন। এ বিয়ের দেন-মাহরের পরিমাণের ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। মুসতাদরিকের একটি বর্ণনায় চার হাজার দীনারের কথা এসেছে। আবু দাউদের বর্ণনায় চার হাজার দিরহমা এসেছে। ইবন আবী খায়সামা ইমাম যুহরী থেকে চল্লিশ উকিয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। তবে আল্লামা যুরকানী চার শো দীনারে বর্ণনাটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।



মাহরের অর্থ হযরত উম্মু হাবীবার (রা) নিকট পৌঁছলে তাঁর থেকে পঞ্চাশ দীনার তিনি দাসী আবরাহাকে দিতে চান। কিন্তু আবরাহা নিতে অসম্মতি জানান এবং বলেন, নাজ্জাশী আমাকে নিতে বারণ করেছেন। উম্মু হাবীবা (রা) পূর্বে যা কিছু তাকে দিয়েছিলেন তাও ফিরিয়ে দেন। বিয়ের পর নাজ্জাশী বহু মিশক, আম্বর, সুগন্ধি এবং আরওান্যান্য জিনিস উপহার হিসেবে উম্মু হাবীবার (রা) নিকট পাঠান। এসব কথা হযরত উম্মু সাহাবী (রা) নিজে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, সে সময় আবরাহা তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা জানায় এবং আমাকে অনুরোধ করে আমি যেন তাঁর ইসলামের কথা রাসূলুল্লহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবহিত করি এবং তাঁর সালাম পৌঁছে দিই। উম্মু হাবীবা (রা) বলেন, মদীনায় পৌঁছে আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ের সব কথা বলি এবং আবরাহার সকল আচরণের কথা অবহিত করে তাঁর সালাম পেশ করি। তিনি মৃদু হেসে বলেনঃ



রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে উম্মু হাবীবার (রা) এ বিয়ে হিজরী ৬, মতান্তরে ৭ সনে সম্পন্ন হয়। তখন উম্মুল মু’মিনীন উম্মু হাবীবার বয়স ৩৬ অথবা ৩৭ বছর হবে। বিয়ের পর নাজ্জাশী শুরাহবীল ইবন হাসানার (রা) মতান্তরে জা‘ফর ইবন আবী তালিবের (রা) নেতৃত্বে একদল মুহাজিরের সাথে উম্মু হাবীবাকে (রা) জাহাজযোগে মদীনায় পাঠিয়ে দেন। এই কাফেলা যখন মদীনায় পৌঁছে তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বারে অবস্থান করছিলেন।



ইবন হাযাম (রা) দাবী করেছেন যে, উম্মু হাবীবার (রা) ‘অকদ হাবশায় হওয়ার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে। এ বিষয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞরা একমত। তবে হযরত কাতাদা (রা) ও ইমাম যুহরীর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, উম্মু হাবীবার (রাঃ)এ ‘আকদ অনুষ্ঠিত হয় মদীনায় ‘উসমান ইবন ‘আফফানের (রা) ব্যবস্থাপনারয়।



এ বিয়েতে ওলীমা করা হয় এবং তাতে তিনি মেহমানদেরকে গোশত খাওয়ান। সীরাত বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেছেন, হতে পারে মদীনায় আসার পর আবার একটি ‘আকদ ও ওলীমা অনুষ্ঠান করা হয়।



সহীহ মুসলিমের একটি বর্ণনায় এসেছে, মানুষ মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণকারী আবু সুফইয়ানকে সুনজরে দেখতো না এবং তাঁর সাউেঠাবসাও পছন্দ করতো না। তাই তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট তিনিটি জিনিসের আবেদন জানান। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। সেই তিনিটি জিনিসের একটি হলোঃ সুফইয়ান বলেন, আমার কাছে আরবের সেরা সুন্দরী মেয়ে হলো উম্মু হাবীবা, আপনি তাকে বিয়ে করুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাজী হন।



এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় আবু সুফইয়ানের (রা) ইসরাম গ্রহণের সময় পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে উম্মু হাবীবার (রা) বিয়ে হয়নি। সীরাত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটা বর্ণনাকারীর একটি ধারণা মাত্র। তাই ইবন সা‘দ, ইবন হাযাম, ইনুল জাওযী, ইবনুল আসীর, বায়হাকী, ‘আবদুল ‘আজীম মুনজিরপ্রিমুখ মুহাদ্দিসীন মুসরিমের উপরোক্ত বণৃনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনেকে এ বর্ণনায় ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে যে, মূলতঃ আবু সুফইয়ান দ্বিতীয়বার আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করার কথা বলেন।



উম্মু হাবীবা (রা) ‘আকদ যে হাবশায় হয়েছিল সে ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের ঐকমত্যের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। তাছাড়া এর সপক্ষে আরও একটি ঘটনার কথা সীরাতের গ্রন্থাবলীতে সংকলিত হয়েছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারা অনুযায়ী মক্কার পার্শ্ববর্তী খুযা‘আ গোত্র মদীনার মুসলমানদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। এতে কুরাইশরা এই চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের উপর অত্যাচার চালানয়। কুযা‘আ পোত্র রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহায্য প্রার্থনা করে। এতে মকআকর কুরাইশরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা সন্ধিচুক্তি বলবৎ রাখার জন্যাতদের পক্ষ থেকে আবু সুফইয়ানকে মদীনায় পাঠায়। আবু সুফইয়ান মদীনায় এসে প্রথমে কন্যা উম্মুর মু’মিনীন উম্মুহাবীবার (রা) নিকট যান। কন্যা পিতাকে দেখে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিছানা গুটিয়ে বসতে দেন। আবু সুফইয়ান মেয়েকে প্রশ্ন করেন, মেযে! তুমি বিছানা গুটিয়ে নিলে। তা বিছানা আমার বসার উপযুক্ত মনে না করে, না আমাকে বিছানার উপযুক্ত মনে না করে? মেযে বললেন, এটা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিছানা। আর আপনি একজন মুশরিক (অংশীবাদী) ও অপবিত্র। এ কারণে আমি ইচ্ছা করিনি যে, আপনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিছানায় বসুন। মেয়ের এমন কথা শুনে আবু সুফইয়ান সেখানে থেকে উঠে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট গিয়ে বসেন এবং মেয়েকে বলেনঃ



আমাকে ছাড়ার পর তোমার মধ্যে অনেক মন্দ ঢুকেছে।



উপরোক্ত ঘটনা দআবরা বুঝা যায় আবু সুফইয়ানের ইসলাম গ্রহণের অনেক আগে উম্মু হাবীবা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীর মর্যদা লাভ করেন। তাছাড়া ইবন সা‘দের একটি বর্ণনায় এসেছে। উম্মু হাবীবার (রা) বিয়ের খবর মক্কায় আবু সুফইয়ানের নিকট পৌঁছে। তখন তিনি রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিপক্ষ ও দুশমন। তবে তিনি এ বিয়েকে অপছন্দ করেননি। তিনি মন্তব্য করেনঃ



-এ এমন সম্ভ্রান্ত কুফু যা প্রত্যাখ্যান করা যায় না।



হযরত উম্মু হাবীবা (রা) তাঁর ভাই হযরত আমীর মু‘আবিয়ার (রা) খিলাফতকালে হিজরী ৪৪ মতান্তরে ৪২ সনে মদীনায় ইনতিকাল করেন। তাকে মদীনায় দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। মারওয়ান জানাযার নামায পড়ান। তাই ভাই ও বোনের ছেলেরা কবরে নেমে তাঁকে সমাহিত করেন। কবরের ব্যাপারে এতটুকু জানা যায় যে, সেটা হযরত আলীর (রা) গৃহে ছিল। ইমাম যায়নুল আবেদীন (রহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একবার আমি আমরর বাড়ীর একটি কোণা খুড়লাম। সেখানে একটি শীলালিপি পেরাম। তাতে লেখা ছিল-



‘এটা রামলা বিল সাখর-এর কবর।’ আমি সেটা আবার সেখানে রেখে দিই। এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় তাঁর কবরটি আলীর (রা) ঘরে ছিল। তিনি তাঁর ভাই হযরত মু‘আবিয়ার (রা) সাথে সাক্ষাতের জন্য দিমাশক সফরে গিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, সেখানে মারা যান এবং সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয়। ইমাম জাহাবী বলেন, এটা ভিত্তিহীন কথা, তাঁর কবর মদীনায়।



মৃত্যুর পূর্বে তিনি হযরত আয়িশা (রা) ও হযরত উম্মু সালামাকে (রা) ডেকে আনান। তিনি তাঁদেরকে বলেন, আমার ও আপনাদের মধ্রে তেমন সম্পর্ক ছিল, যেমন সতীনদের পরস্পরের থাকে। যেহেতু আপনারা তেমন চেয়েছিলেন, তাই আমিও তাই পছন্দ করেছিরাম। আপনারা আমার মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করুন। হযরত আয়িশা (রা) তাঁর মাগফিরাতেরজন্য দু‘আ করলে তিনি খুশী হয়ে বলেনঃ



-আপনি আমাকে খুশী করেছেন, আল্লাহ আপনাকে খুশী করুন।



প্রথম স্বামীর ঔরসে দুইটি সন্তান ‘আবদুল্লাহ ও হাবীবা জন্মগ্রহণ করে। হাবীবা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গৃহে তাঁরই তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। সাকীফ গোত্রের এক বড় নেতার সাথে তার বিয়ে হয়।



হযরত উম্মু হাবীবা (রা) খুবই রূপবতী ছিলেন। সহীহ মুসরিমে পিতা আবু সুফইয়ানের বর্ণনা এভাবে এসেছেঃ



-আমার কাছে আরবের সেরা সুন্দরী ও সেরা রূপবতী কন্যা উম্মু হাবীবা।



হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে হযরত উম্মু হাবীবার (রা) পয়ষট্টিটি (৬৫) হাদীস সংকরিত হয়েছে। তার মধ্যে দুইটি হাদীস মুত্তাফাক ‘আলাইহি এবং দুইটি ইমাম মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর সূত্রে যে সকল রাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়, তাঁদের মধ্রে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ হাবীবা (কন্যা), মু‘আবিয়া, ‘উতবা (আবু সুফইয়ানের দুই ছেলে), আবদুল্লাহ ইবন উতবা, আবু সুফইয়ান ইবন সা‘ঈদ সাকাফী, সালিম ইবনসাওয়ার, আবুল জাররাহ, সাফিয়্যা বিনত শায়বা, যায়নাব বিতন উম্মু সালামা, উরওয়া ইবন যুবাইর, আবু সালিহ আস-সম্মান, শাহর ইবন হাওশাব, আনবাসা, শুতাইর ইবন শাকাল, আবুল মালীহ আমির আল-হুজালী প্রমুখ।



উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু হাবীবা (রাঃ) অত্যন্ত শক্ত ঈমানদার মহিলা ছিলেন। তিনি যে যুগের মহিলা, সে অনুপাতে যে ধৈর্য, দূঢ়তা ও বিচকষণতা দেখিয়েছেন, তা ভেবে দেখলে বিম্মিত না হয়ে পারা যায় না। ইসলামের আবির্ভাবকালেই তিনি স্বীয় মেধা ও বুদ্ধি দ্বারাসত্যকে চিনতে পেরে আঁকড়ে ধরেন। যে কাজ সে সময়ের অনেক বড় বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা করতে পারেনি, বা করতে যাদের অনেক সময় লেগেছে, তিনি সহজেই তা করতে পেরেছেন। সত্যের জন্য তিনি মা-বাবা, ভাই-বোনেসহ সকল আত্মীয় বন্ধুদের ছেড়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। যে স্বামীকে অবলম্বন করে সবকিছু ছাড়লেন, বিদেশ-বিভূঁইয়ে সে স্বামী তাঁকে ছেড়ে গেল। কিন্তু তিনি সত্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হলেন না। তিনি তাঁর বিশ্বাসের উপর পর্বত পরিমাণ অটল থাকরেন। কী পরিমাণ বিশ্বাসের জোর থাকলে এতকিছু করা যায়? সম্ভবতঃ তাঁই এই মজবুল ঈমানের জন্যই আল্লাহ পাক পুরষ্কার স্বরূপ দুনিয়াতে উম্মুল মু’মিনীনের সুমহান মর্যাদা দান করেন।



মজবুল ঈমানের সাথে আল্লাহর রাসূলে প্রতি সীমাহীন ভালোবাসাও তাঁর অন্তরে ছিল। আল্লাহর রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি যে কত বড় ও পবিত্র বলে জানতেন তার প্রমণ পাওয়া যায় তাঁর মুশরিক পিতাকে রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিছানায় বতে না দেওয়ার মাধ্যমে। তিনি পিতার মুখের উপর বলে দিলেন, আপনি মুশরিক, অপবিত্র। আমি চাই না আপনি আল্লাহর রাসূলের (রা) বিছানায় বসে অপবিত্র করুন। এরই নাম ঈমান, এরই নাম আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূরের প্রতি ভালোবাসা।



হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসের উপর তিনি নিজে যেমন কটোরভাবে আমল করতেন, তেমনি অন্যদেরও আমল করার তাকীদ তিনে। তাঁর ভাগিনা আবু সুফইয়ান ইবন সা‘ঈদ ইবন আল-মুগীরা একবার দেখা করতে আসেন। তিনি ছাতু খেযে শুধু কুলি করলেন, উম্মুল মু’মিনীন বললেন, তোমার ওজু করা উচিত। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আগুনে পাকানো কোন জিনিস খেলে ওজু করতে হবে।



পিতা আবু সুফইয়ানের (র) ইনতিকালের তিনদিন পর তিনি সুগন্ধি চেয়ে নিয়ে কপালে মাখেন এবং বলেনঃ



-আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি, আল্লাহও পরকালে বিশ্বাসী কোন মহিলার একমাত্র স্বামী ছাড়া কোন মৃতব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশি শোক করা জায়েয নেই। স্বামীর জন্য চর মাস দশ দিন শোক করবে।



একবার তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখে শুনলেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন বারো রাক‘আত নফল নামায আদায় করবে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানানো হবে। উম্মু হাবীবা বলেন, তারপর থেকে আমিসর্বদাই তা আদায় করে থাকি। এর ফল এই দাঁড়ায় যে, তাঁর ছাত্র এবং ভাই ‘উতবা, ‘উতবার ছাত্র ‘আমার ইবন উওয়াইস এবং ‘আমরের ছাত্র নু‘মান ইবন সালিম প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ সময়কালে এ নামায সব সময় আদায় করতেন।



স্বভাবগতভাবেই তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ। একবার তিনি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আপনি আমার বোনকে বিয়ে করুন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘তুমি কি তা চাও?’ বললেন, ‘কেন চাইবো না। এতে ক্ষতি কি!! আমি এবং আমার কোন বোনকে কোন ভালো অবস্থায় দেখতে বাধা থাকা উচিত নয়।’



আল্লাহ জাহাবী তাঁর মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, বংশের দিক দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বেগমই তাঁর চেয়ে বেশি নিকটের ছিলেন না। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বেগমেরই মাহর তাঁর চেয়ে বেশি ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বেগমকেই তাঁর চেয়ে বেশি দূরে অবস্থান করা অবস্থায় বিয়ে করেননি।



হযরত উবন আববাস (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন হযরত উম্মু হাবীবাকে (রা) বিয়ে করেন তখন নিম্নের এ আয়াতটি নাযিল হয়ঃ



-‘যারা তোমাদের শত্রু আল্লাহ তাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সম্ভাবত বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।’ (সূলা আল)

Comments

Popular posts from this blog

হযরত হাফসা (রাঃ)

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)