হযরত শো‘আয়েব (আঃ)

হযরত শো‘আয়েব (আঃ)

আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রধান ৬টি প্রাচীন জাতির মধ্যে পঞ্চম জাতি হ’ল ‘আহলে মাদইয়ান’। ‘মাদইয়ান’ হ’ল লূত সাগরের নিকটবর্তী সিরিয়া ও হিজাযের সীমান্তবর্তী একটি জনপদের নাম। যা অদ্যাবধি পূর্ব জর্ডনের সামুদ্রিক বন্দর ‘মো‘আন’ এর অদূরে বিদ্যমান রয়েছে। কুফরী করা ছাড়াও এই জনপদের লোকেরা ব্যবসায়ের ওযন ও মাপে কম দিত, রাহাজানি ও লুটপাট করত। অন্যায় পথে জনগণের মাল-সম্পদ ভক্ষণ করত।[1] ইয়াকূত হামাভী (মৃঃ ৬২৬/১২২৮খৃঃ) বলেন, ইবরাহীম-পুত্র মাদইয়ানের নামে জনপদটি পরিচিত হয়েছে।[2] হযরত শো‘আয়েব (আঃ) এদের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। ইনি হযরত মূসা (আঃ)-এর শ্বশুর ছিলেন। কওমে লূত-এর ধ্বংসের অনতিকাল পরে কওমে মাদইয়ানের প্রতি তিনি প্রেরিত হন (হূদ ১১/৮৯)। চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি  ‘খাত্বীবুল আম্বিয়া’ (নবীগণের মধ্যে সেরা বাগ্মী) নামে"খ্যাত ছিলেন।[3] আহলে মাদইয়ান-কে পবিত্র কুরআনে কোথাও কোথাও ‘আছহাবুল আইকাহ’  বলা হয়েছে। যার অর্থ ‘জঙ্গলের বাসিন্দাগণ’। এটা বলার কারণ এই যে, এই অবাধ্য জনগোষ্ঠী প্রচন্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে নিজেদের বসতি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে আল্লাহ তাদেরকে সেখানেই ধ্বংস করে দেন। এটাও বলা হয় যে, উক্ত জঙ্গলে ‘আইকা’  বলে একটা গাছকে তারা পূজা করত। যার আশপাশে জঙ্গল বেষ্টিত ছিল।

মাদইয়ান  ছিলেন হাজেরা ও সারাহর মৃত্যুর পরে হযরত ইবরাহীমের আরব বংশোদ্ভূত কেন‘আনী স্ত্রী ক্বানতূরা বিনতে ইয়াক্বত্বিন  -এর ৬টি পুত্র সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র।[4]

উল্লেখ্য যে, হযরত শো‘আয়েব (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[5]

হযরত শো‘আয়েব (আঃ)-এর দাওয়াত :

ধ্বংসপ্রাপ্ত বিগত কওমগুলোর বড় বড় কিছু অন্যায় কর্ম ছিল। যার জন্য বিশেষভাবে সেখানে নবী প্রেরিত হয়েছিলেন। শো‘আয়েব-এর কওমেরও তেমনি মারাত্মক কয়েকটি অন্যায় কর্ম ছিল, যেজন্য খাছ করে তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকটে শো‘আয়েব (আঃ)-কে প্রেরণ করা হয়। তিনি তাঁর কওমকে"যে দাওয়াত দেন, তার মধ্যেই বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,


‘আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শো‘আয়েবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ"কর। মানুষকে তাদের মালামাল কম দিয়ো না। ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধনের পর তোমরা সেখানে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’। ‘তোমরা পথে-ঘাটে এ কারণে বসে থেকো না যে, ঈমানদারদের হুমকি দেবে, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করবে"ও তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ কর, যখন তোমরা সংখ্যায় অল্প ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে আধিক্য দান করেছেন এবং লক্ষ্য কর কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে অনর্থকারীদের’। ‘আর যদি তোমাদের একদল ঐ বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যা নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি"এবং আরেক দল বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর যে পর্যন্ত না আল্লাহ আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। কেননা তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়ছালাকারী’ (আ‘রাফ ৭/৮৫-৮৭)।

কওমে শো‘আয়েব-এর ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা এবং দাওয়াতের সারমর্ম:

উপরোক্ত আয়াত সমূহে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ তারা আল্লাহর হক ও বান্দার হক দু’টিই নষ্ট করেছিল। আল্লাহর হক হিসাবে তারা বিশ্বাসের জগতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির পূজায় লিপ্ত হয়েছিল কিংবা আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করেছিল। তারা আল্লাহর"ইবাদত ছেড়ে দিয়েছিল। দুনিয়াবী ধনৈশ্বর্যে ও বিলাস-ব্যসনে ডুবে গিয়ে তারা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তাঁর হক সম্পর্কে গাফেল হয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে নিজেদের পাপিষ্ঠ জীবনের মুক্তির জন্য বিভিন্ন সৃষ্ট বস্ত্তকে শরীক সাব্যস্ত করে তাদের অসীলায় মুক্তি কামনা"করত। এভাবে তারা আল্লাহ ও তাঁর গযবের ব্যাপারে নিঃশংক হয়ে গিয়েছিল। সেকারণ সকল নবীর ন্যায় শো‘আয়েব (আঃ) সর্বপ্রথম আক্বীদা সংশোধনের জন্য ‘তাওহীদে ইবাদত’-এর আহবান জানান। যাতে তারা সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করে এবং সকল ব্যাপারে স্রেফ"আল্লাহর ও তাঁর নবীর আনুগত্য করে। তিনি নিজের নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ তাদেরকে মু‘জেযা প্রদর্শন করেন। যা স্বয়ং প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ’ রূপে তাঁর নিকটে আগমন করে।

দ্বিতীয়তঃ তারা মাপ ও ওযনে কম দিয়ে বান্দার হক নষ্ট করত। সেদিকে ইঙ্গিত করে শো‘আয়েব (আঃ) বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ কর এবং মানুষের দ্রব্যাদিতে কম দিয়ে তাদের ক্ষতি করো না’ (আ‘রাফ ৭/৮৫)। আয়াতের প্রথমাংশে খাছভাবে মাপ ও ওযন পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে"এবং শেষাংশে সর্বপ্রকার হকে ত্রুটি করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সে হক মানুষের ধন-সম্পদ, ইযযত-আবরূ বা যেকোন বস্ত্তর সাথে সম্পর্কযুক্ত হৌক না কেন। বস্ত্ততঃ দ্রব্যাদির মাপ ও ওযনে কম দেওয়া যেমন মহা অপরাধ, তেমনি কারু ইযযত-আবরূ নষ্ট করা, কারু পদমর্যাদা অনুযায়ী"তাকে সম্মান না করা, যাদের আনুগত্য করা যরূরী তাদের আনুগত্যে ত্রুটি করা অথবা যাকে সম্মান করা ওয়াজিব তার সম্মানে ত্রুটি করা ইত্যাদি সবই এ অপরাধের অন্তর্ভুক্ত, যা শো‘আয়েব (আঃ)-এর সম্প্রদায় করত। সে সমাজে মানীর মান ছিল না বা গুণীর কদর ছিল না।

তৃতীয়তঃ বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, সেখানে সংস্কার সাধিত হওয়ার পর’ (আ‘রাফ ৭/৮৫)। অর্থাৎ আল্লাহ পৃথিবীকে যেভাবে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সবদিক দিয়ে সুন্দর ও সামঞ্জস্যশীল করে সৃষ্টি করেছেন, তোমরা তাতে ব্যত্যয় ঘটিয়ো না এবং কোনরূপ অনর্থ"সৃষ্টি করো না।

চতুর্থতঃ তোমরা মানুষকে ভীতি প্রদর্শন ও আল্লাহর পথে বাধা দানের উদ্দেশ্যে পথে-ঘাটে ওঁৎ পেতে থেকো না (আ‘রাফ ৭/৮৬)। এর দ্বারা মাদইয়ান বাসীদের আরেকটি মারাত্মক দোষের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তারা রাস্তার মোড়ে চৌকি বসিয়ে লোকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে চাঁদা"আদায় করত ও লুটপাট করত। সাথে সাথে তারা লোকদেরকে শো‘আয়েব (আঃ)-এর উপরে ঈমান আনতে নিষেধ করত ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করত। তারা সর্বদা আল্লাহর পথে বক্রতার সন্ধান করত’ (আ‘রাফ ৭/৮৬) এবং কোথাও অঙ্গুলি রাখার জায়গা পেলে আপত্তি ও সন্দেহের ঝড় তুলে মানুষকে সত্যধর্ম"হ’তে বিমুখ করার চেষ্টায় থাকত।

মাদইয়ানবাসীদের আরেকটি দুষ্কর্ম ছিল যে, তারা প্রচলিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পার্শ্ব হ’তে সোনা ও রূপার কিছু অংশ কেটে রেখে সেগুলো বাজারে চালিয়ে দিত। শো‘আয়েব (আঃ) তাদেরকে একাজ থেকে নিষেধ করেন।[6]

পঞ্চমতঃ তাদের অকৃতজ্ঞতার বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘স্মরণ কর তোমরা যখন সংখ্যায় কম ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের বংশবৃদ্ধি করে তোমাদেরকে একটি বিরাট জাতিতে পরিণত করেছেন’ (আ‘রাফ ৭/৮৬)। তোমরা ধন-সম্পদে হীন ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রাচুর্য"দান করেছেন। অথচ তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে নানাবিধ শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হয়েছ। অতএব তোমরা সাবধান হও এবং তোমাদের পূর্ববর্তী কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ ও কওমে লূত-এর ধ্বংসলীলার কথা স্মরণ কর (আ‘রাফ ৭/৮৬)। তাদের মর্মান্তিক পরিণাম ও অকল্পনীয় গযবের"কথা মনে রেখে হিসাব-নিকাশ করে পা বাড়াও।

ষষ্ঠতঃ মাদইয়ানবাসীদের উত্থাপিত একটি সন্দেহের জবাব দেওয়া হয়েছে। তারা বলত যে, ঈমানদারগণ যদি ভাল ও সৎ হয়, আর আমরা কাফিররা যদি মন্দ ও পাপী হই, তাহ’লে আমাদের উভয় দলের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা একরূপ কেন? কাফিররা অপরাধী হ’লে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের শাস্তি"দিতেন। এর উত্তরে নবী বলেন, ‘অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মাঝে ফায়ছালা করেন বস্ত্ততঃ তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী’ (আ‘রাফ ৭/৮৭)। অর্থাৎ আললাহ স্বীয় সহনশীলতা ও কৃপাগুণে"পাপীদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর তারা যখন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়, তখন সত্য ও মিথ্যার ফায়ছালা নেমে আসে। তোমাদের অবস্থাও তদ্রূপ হবে। অবিশ্বাসী ও পাপীদের উপরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব সত্বর নাযিল হয়ে যাবে। একই ধরনের বক্তব্য উল্লেখিত হয়েছে সূরা হূদে (১১/৮৪-৮৬"আয়াতে)।

হযরত শো‘আয়েব (আঃ) একথাও বলেন যে, ‘(আমার এ দাওয়াতের জন্য) আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান বিশ্বপালনকর্তাই দেবেন’ (শু‘আরা ২৬/১৮০)। তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও শেষ দিবসের আশা রাখ। তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না’ (আনকাবূত"২৯/৩৬)।

শো‘আয়েব (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :

হযরত শো‘আয়েব (আঃ)-এর নিঃস্বার্থ ও আন্তরিকতাপূর্ণ দাওয়াত তাঁর উদ্ধত কওমের নেতাদের হৃদয়ে রেখাপাত করল না। তারা বরং আরও উদ্ধত হয়ে তাঁর দরদ ভরা সুললিত বয়ান ও অপূর্ব চিত্তহারী বাগ্মীতার জবাবে পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত কওমের পাপিষ্ঠ নেতাদের ন্যায় নবীকে প্রত্যাখ্যান"করল এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও তাচ্ছিল্য করে বলল,  ‘তোমার ছালাত কি তোমাকে একথা শিখায় যে, আমরা আমাদের ঐসব"উপাস্যের পূজা ছেড়ে দিই, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে যে সবের পূজা করে আসছে? আর আমাদের ধন-সম্পদে ইচ্ছামত আমরা যা কিছু করে থাকি, তা পরিত্যাগ করি? তুমি তো একজন সহনশীল ও সৎ ব্যক্তি’ (হূদ ১১/৮৭)। অর্থাৎ তুমি একজন জ্ঞানী, দূরদর্শী ও সাধু ব্যক্তি"হয়ে একথা কিভাবে বলতে পার যে, আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা দেব-দেবীর পূজা ও শেরেকী প্রথা সমূহ পরিত্যাগ করি এবং আমাদের আয়-উপাদানে ও রূযী-রোজগারে ইচ্ছামত চলা ছেড়ে দেই। আয়-ব্যয়ে কোন্টা হালাল কোন্টা হারাম তা তোমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে কাজ করতে"হবে এটা কি কখনো সম্ভব হ’তে পারে? তাদের ধারণা মতে তাদের সকল কাজ চোখ বুঁজে সমর্থন করা ও তাতে বরকতের জন্য দো‘আ করাই হ’ল সৎ ও ভাল মানুষদের কাজ। ঐসব কাজে শিরক ও তাওহীদ, হারাম ও হালালের প্রশ্ন তোলা কোন ধার্মিক (?) ব্যক্তির কাজ নয়।

দ্বিতীয়তঃ তারা ইবাদাত ও মু‘আমালাতকে পরস্পরের প্রভাবমুক্ত ভেবেছিল। ইবাদত কবুলের জন্য যে রূযী হালাল হওয়া যরূরী, একথা তাদের বুঝে আসেনি। সেজন্য তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে হালাল-হারামের বিধান মানতে রাযী ছিল না। যদিও ছালাত আদায়ে কোন আপত্তি তাদের ছিল না। কেননা"দেব-দেবীর পূজা সত্ত্বেও সৃষ্টিকর্তা হিসাবে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও স্বীকৃতি সবারই ছিল (লোকমান ৩১/২৫)। তাদের আপত্তি ছিল কেবল একখানে যে, সবকিছু ছেড়ে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে এবং দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে।"তারা ধর্মকে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত মনে করত এবং ব্যবহারিক জীবনে তার কোন দখল দিতে প্রস্ত্তত ছিল না। শো‘আয়েব (আঃ) অধিকাংশ সময় ছালাত ও ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন বলে তাকে বিদ্রূপ করে কোন কোন মূর্খ নেতা এরূপ কথাও বলে ফেলে যে, তোমার ছালাত কি তোমাকে"এসব আবোল-তাবোল কথা-বার্তা শিক্ষা দিচ্ছে?

কওমের লোকদের এসব বিদ্রূপবান ও রূঢ় মন্তব্য সমূহে বিচলিত না হয়ে অতীব ধৈর্য ও দরদের সাথে তিনি তাদের সম্বোধন করে বললেন,


‘হে আমার জাতি! তোমরা কি মনে কর আমি যদি আমার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে সুস্পষ্ট দলীলের উপরে কায়েম থাকি, আর তিনি যদি নিজের তরফ থেকে আমাকে (দ্বীনী ও দুনিয়াবী) উত্তম রিযিক দান করে থাকেন, (তবে আমি কি তাঁর হুকুম অমান্য করতে পারি?)। আর আমি চাই না যে, আমি তোমাদেরকে"যে বিষয়ে নিষেধ করি, পরে নিজেই সে কাজে লিপ্ত হই। আমি আমার সাধ্যমত তোমাদের সংশোধন চাই মাত্র। আর আমার কোনই ক্ষমতা নেই আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত। আমি তাঁর উপরেই নির্ভর করি এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাই’ (৮৮)। ‘হে আমার জাতি! আমার প্রতি হঠকারিতা করে তোমরা নিজেদের"উপরে নূহ, হূদ বা ছালেহ-এর কওমের মত আযাব ডেকে এনো না। আর লূতের কওমের ঘটনা তো তোমাদের থেকে দূরে নয়’ (৮৯)। ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকেই ফিরে এস। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা অতীব দয়ালু ও প্রেমময়’ (৯০)। ‘তারা বলল, হে শো‘আয়েব!"তোমার অত শত কথা আমরা বুঝি না। তোমাকে তো আমাদের মধ্যকার একজন দুর্বল ব্যক্তি বলে আমরা মনে করি। যদি তোমার জাতি-গোষ্ঠীর লোকেরা না থাকত, তাহ’লে এতদিন আমরা তোমাকে পাথর মেরে চূর্ণ করে ফেলতাম। তুমি আমাদের উপরে মোটেই প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি নও’ (৯১)। ‘শো‘আয়েব"বলল, হে আমার কওম! আমার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী কি তোমাদের নিকটে আল্লাহর চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালী? অথচ তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ করে পিছনে ফেলে রেখেছ? মনে রেখ তোমাদের সকল কার্যকলাপ আমার পালনকর্তার আয়ত্তাধীন’ (৯২)। ‘অতএব হে আমার জাতি! তোমরা তোমাদের স্থানে কাজ কর,"আমিও কাজ করে যাই। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে কার উপরে লজ্জাষ্কর আযাব নেমে আসে, আর কে মিথ্যাবাদী। তোমরা অপেক্ষায় থাক, আমিও অপেক্ষায় রইলাম’ (হূদ ১১/৮৮-৯৩)।

জবাবে ‘তাদের দাম্ভিক নেতারা চূড়ান্তভাবে বলে দিল,  ‘হে শো‘আয়েব! আমরা অবশ্যই তোমাকে ও তোমার সাথী ঈমানদারগণকে শহর থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা"আমাদের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করবে’ (আ‘রাফ ৭/৮৮)। তারা আরও বলল,

‘নিঃসন্দেহে তুমি জাদুগ্রস্তদের অন্যতম’। ‘তুমি আমাদের মত একজন মানুষ বৈ কিছুই নও। আমাদের ধারণা তুমি অবশ্যই মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘এক্ষণে যদি তুমি সত্যবাদী হও, তবে আকাশের কোন টুকরা আমাদের উপরে ফেলে দাও’ (শো‘আরা ২৬/১৮৫-১৮৭)। শো‘আয়েব (আঃ) তখন নিরাশ"হয়ে প্রথমে কওমকে বললেন,


‘আমরা আল্লাহর উপরে মিথ্যারোপকারী হয়ে যাব যদি আমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে যাই। অথচ আল্লাহ আমাদেরকে তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। ঐ ধর্মে ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে যদি আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ সেটা চান। আমাদের পালনকর্তা স্বীয় জ্ঞান দ্বারা প্রত্যেক"বস্ত্তকে বেষ্টন করে আছেন। (অতএব) আল্লাহর উপরেই আমরা ভরসা করলাম।’

অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বললেন,  ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ও আমাদের কওমের মধ্যে তুমি যথার্থ ফায়ছালা করে দাও। আর তুমিই তো শ্রেষ্ঠ ফায়ছালাকারী’ (৮৯)।"‘তখন তার কওমের কাফের নেতারা বলল, যদি তোমরা শো‘আয়েবের অনুসরণ কর, তবে তোমরা নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (আ‘রাফ ৭/৮৯-৯০)।

অতঃপর শো‘আয়েব (আঃ) স্বীয় কওমের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
‘অনন্তর তিনি তাদের কাছ থেকে প্রস্থান করলেন এবং বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে আমার প্রতিপালকের পয়গাম পৌছে দিয়েছি এবং তোমাদের উপদেশ দিয়েছি। এখন আমি কাফেরদের জন্য আর কিভাবে সহানুভূতি দেখাব’ (আ‘রাফ ৭/৯৩)।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

হযরত শো‘আয়েব (আঃ) ও তাঁর কওমের নেতাদের মধ্যকার উপরোক্ত কথোপকথনের মধ্যে নিম্নোক্ত শিক্ষণীয় বিষয়গুলি ফুটে ওঠে। যেমন:

(১) শো‘আয়েব (আঃ) একটি সম্ভ্রান্ত গোত্রের মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। নবুঅতের সম্পদ ছাড়াও তিনি দুনিয়াবী সম্পদে সমৃদ্ধিশালী ছিলেন। বস্ত্ততঃ সকল নবীই স্ব স্ব যুগের সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তারা উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তি ছিলেন। (২) কওমের নেতারা"ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় বিধি-বিধান মানতে প্রস্ত্তত থাকলেও বৈষয়িক জীবনে ধর্মীয় বাধা-নিষেধ মানতে রাযী ছিল না (৩) আল্লাহকে স্বীকার করলেও তাদের মধ্যে অসীলা পূজা ও মূর্তিপূজার শিরকের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল (৪) বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসমপূজা ছেড়ে নির্ভেজাল"তাওহীদের সংস্কার ধর্মী দাওয়াত তারা কবুল করতে প্রস্ত্তত ছিল না (৫) মূলতঃ দুনিয়া পূজা ও প্রবৃত্তি পূজার কারণেই তারা শিরকী রেওয়াজ এবং বান্দার হক বিনষ্টকারী অপকর্ম সমূহের উপরে যিদ ধরেছিল।

(৬) প্রচলিত কোন অন্যায় রসমের সঙ্গে আপোষ করে তা দূর করা সম্ভব নয়। বরং শত বাধা ও ক্ষতি স্বীকার করে হ’লেও স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে আপোষহীনভাবে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াই প্রকৃত সমাজ সংস্কারকের কর্তব্য (৭) সংস্কারককে সর্বদা স্পষ্ট দলীলের উপরে"কায়েম থাকতে হবে (৮) তাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল ও প্রকৃত সমাজদরদী হ’তে হবে (৯) কোনরূপ দুনিয়াবী প্রতিদানের আশাবাদী হওয়া চলবে না (১০) সকল ব্যাপারে কেবল আল্লাহর তাওফীক কামনা করতে হবে এবং প্রতিদান কেবল তাঁর কাছেই চাইতে হবে (১১) শিরক-বিদ‘আত ও যুলুম অধ্যুষিত"সমাজে তাওহীদের দাওয়াতের মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াকে দুনিয়াদার সমাজনেতারা ‘ফাসাদ’ ও ‘ক্ষতিকর’ মনে করলেও মূলতঃ সেটাই হ’ল ‘ইছলাহ’ বা সমাজ সংশোধনের কাজ। সকল বাধা উপেক্ষা করে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যাওয়াই হ’ল সংস্কারকের মূল কর্তব্য (১২)"চূড়ান্ত অবস্থায় আল্লাহর নিকটেই ফায়ছালা চাইতে হবে।

আহলে মাদইয়ানের উপরে আপতিত গযবের বিবরণ :

হযরত শো‘আয়েব (আঃ)-এর শত উপদেশ উপেক্ষা করে যখন কওমের নেতারা তাদের অন্যায় কর্মসমূহ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে অনড় রইল এবং নবীকে জনপদ থেকে বের করে দেবার ও হত্যা করার হুমকি দিল ও সর্বোপরি হঠকারিতা করে তারা আল্লাহর গযব প্রত্যক্ষ করতে চাইল, তখন তিনি বিষয়টি"আল্লাহর উপরে সোপর্দ করলেন এবং কওমের নেতাদের বললেন, ‘(ঠিক আছে), তোমরা এখন আযাবের অপেক্ষায় থাক। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় রইলাম’ (হূদ ১১/৯৩)।

বলা বাহুল্য, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় চিরন্তন বিধান অনুযায়ী শো‘আয়েব (আঃ) ও তাঁর ঈমানদার সাথীগণকে উক্ত জনপদ হ’তে অন্যত্র নিরাপদে সরিয়ে নিলেন। অতঃপর জিবরীলের এক গগণবিদারী নিনাদে অবাধ্য কওমের সকলে নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,


‘অতঃপর যখন আমার আদেশ এসে গেল, তখন আমি শো‘আয়েব ও তার ঈমানদার সাথীদের নিজ অনুগ্রহে রক্ষা করলাম। আর পাপিষ্ঠদের উপর বিকট গর্জন আপতিত হ’ল। ফলে তারা নিজেদের ঘরে উপুড় হয়ে মরে পড়ে রইল’। ‘(তারা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হ’ল) যেন তারা কখনোই সেখানে বসবাস করেনি। সাবধান!"ছামূদ জাতির উপর অভিসম্পাতের ন্যায় মাদইয়ানবাসীর উপরেও অভিসম্পাত’ (হূদ ১১/৯৪-৯৫)। যদিও তারা দুনিয়াতে মযবুত ও নিরাপদ অট্টালিকায় বসবাস করত।

আছহাবে মাদইয়ানের উপরে গযবের ব্যাপারে কুরআনে  (শো‘আরা ১৮৯),(হূদ ৯৪),  (আ‘রাফ ৮৮) তিন ধরনের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বিকট নিনাদ, ভূমিকম্প। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, আহলে মাদইয়ানের উপরে প্রথমে সাতদিন"এমন ভীষণ গরম চাপিয়ে দেওয়া হয় যে, তারা দহন জ্বালায় ছটফট করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা একটি ঘন কালো মেঘমালা পাঠিয়ে দিলেন, যার নীচ দিয়ে শীতল বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল। তখন কওমের লোকেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে সেখানে দৌড়ে এল। এভাবে সবাই জমা হবার পর হঠাৎ ভূমিকম্প"শুরু হ’ল এবং মেঘমালা হ’তে শুরু হল অগ্নিবৃষ্টি। তাতে মানুষ সব পোকা-মাকড়ের মত পুড়ে ছাই হ’তে লাগল। ইবনু আববাস (রাঃ) ও মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল-কুরাযী বলেন, অতঃপর তাদের উপর নেমে আসে এক বজ্রনিনাদ। যাতে সব মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল’।[7] এভাবে কোনরূপ গ্রেফতারী"পরোয়ানা ও সিপাই-সান্ত্রীর প্রহরা ছাড়াই আল্লাহদ্রোহীরা সবাই পায়ে হেঁটে স্বেচ্ছায় বধ্যভূমিতে উপস্থিত হয় এবং চোখের পলকে সবাই নিস্তনাবুদ হয়ে যায়।

মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে এসব ধ্বংসস্থল নযরে পড়ে। আল্লাহ বলেন,َ ‘এসব জনপদ ধ্বংস হওয়ার পর"পুনরায় আবাদ হয়নি অল্প কয়েকটি ব্যতীত। অবশেষে আমিই এ সবের মালিক রয়েছি’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৮)। তিনি বলেন,  ‘নিশ্চয়ই এর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শনসমূহ রয়েছে’ (হিজর ১৫/৭৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন এসব স্থান"অতিক্রম করতেন, তখন আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে পড়তেন ও সওয়ারীকে দ্রুত হাঁকিয়ে নিয়ে স্থান অতিক্রম করতেন।[8] অথচ এখনকার যুগের বস্ত্তবাদী লোকেরা এসব স্থানকে শিক্ষাস্থল না বানিয়ে পর্যটন কেন্দ্রের নামে তামাশার স্থলে পরিণত করেছে। আল্লাহ আমাদের সুপথ প্রদর্শন"করুন- আমীন!

ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বলেন, শু‘আয়েব (আঃ) ও তাঁর মুমিন সাথীগণ মক্কায় চলে যান ও সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। কা‘বা গৃহের পশ্চিম দিকে দারুন নাদওয়া ও দার বনু সাহ্মের মধ্যবর্তী স্থানে তাদের কবর হয়’।[9] তবে এই সকল বর্ণনার ভিত্তি সুনিশ্চিত নয়। আর থাকলেও সেগুলি"সবই এখন নিশ্চিহ্ন এবং সবই বায়তুল্লাহর চতুঃসীমার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

Comments

Popular posts from this blog

হযরত হাফসা (রাঃ)

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)