হযরত উম্মু সালামার (রাঃ)


* উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মু সালামার (রা) আসল নাম ‘হিন্দা’। ‘উম্মু সালামা’ ডাকনাম এবং এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ। অনেকে তাঁর নাম ‘রামলা’ বলেছেন, কিন্তু মহাদ্দিসগণ একে তিত্তিহীন মনে করেছেন। মূলত ‘রামলা’ মু’মিনীন হযরত উম্মু হাবীবার (রা) নাম। উম্মু সালামার (রা) পিতা আবু উমাইয়্যা ইবন আল-মুগীরা ইবন আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আল-মাখযুম। আবু উমাইয়্যার আসল নাম হুজাইফা’। তবে তিনি আবু উমাইয়্যা’ নামেই খ্যাত।৩ তাঁর উপাধি ছির যাদুর রাকব’। যাদুর রাবক’ অর্থ কাফেলার পাথেয়। মক্কার দানশীল ও অতিথি সেবকদের মধ্যে তাঁর এক বিশেষ স্থান ছিল। তিনি যখনকোন কাফেলার সাথে কেথাও বের হতেন তখন গোটা কাফেলার খঅওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিতেন। তাঁর এমন উদারতা ও মহানুভবতায় তুষ্ট হয়ে সমকালীন আরববাসী তাঁকে এ উপাধি দান করেন।৪ উল্লেখ্য যে, সেকালে কুরাইশদের মধ্যে যাদুকর’ উপাধি ধারণকারী ব্যক্তি ছিলেন মোট তিনজন। আবু উমাইয়্যা ইবন আল-মুগীরা, আল-আসওয়াদ ইবন আবদিল মুত্তালিব, মুসাফির ইবন আবী আমর।



মক্কার আবু জাহলের পিতা হিশাম, ‘উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) নানা হাশিম, খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের (রা) পিতা ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা, আবু হুজাইফা মাখযুমী, ‘আয়্যাশ ইবন রাবী‘আর পিতা আবু রাবী‘আ, ফাকিহা, হিন্দা বিনত উতবার প্রথম স্বামী হাফস, আবদু শামস-এঁরা সবাই ছিলেন মুগীরা আল-মাখযুমীর ছেলে, আবু উমাইয়্যার ভাই এবং হযরত উম্মু সালামার (রা) চাচা। আর ‘আমার ইবনুল আসের (রা) মা উম্মু হারমালা বিনত হিশাম, ‘উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) মা খানতামা বিনত হাশিম-উভয়ে ছিলেন উম্মু সালামার (রা) চাচাতো বোন। খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ, আয়্যাশ ইবন আবী রাবী‘আ, সালামা ইবন হিশাম, আবু জাহল ইবন হিশাম, খালিদ ইবন হিশাম, হারিস ইবন হিশাম-এরা সবাই ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই।।



হযয়ত উম্মু সালামার (রা) মাতার নাম ‘আতিকা বিনত আমির ইবন রাবী’আ ইবন মালিক আন-কিনানিয়্যা। কোন কোন গ্রন্থকার মনে করেছেন উম্মু সালামার (রা) মা ‘আতিকা ছিলেন ‘আবদুল মুত্তালিবের কন্যা। সুতরাং উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহর (রা) ফুফাতো বোন। আসলে উম্মু সালামার (রা) পিতার সাথে এই ‘আতিকার বিয়ে হয়েছিল এবং তাঁর গর্ভে আবদুল্লাহ, উম্মু যুহাইর ও কারীবা নামের তিনটি সন্তান জন্মলাভ করে। কিন্তু এ ‘আতিকা উম্মু সালমার (রা) মা নন। তাঁর মা আমির ইবন রাবী‘আর কন্যা ‘আতিকা। --##--



**** প্রথম বিয়ে

হযরত উম্মু সালামার (রা) প্রথম বিয়ে হয় ‘আবদুল্লাহ ইবন আবদিল আসাদ আল-মাখযুমীর সাথে। যার ডাকনাম আবু সালামা এবং এ নামেই প্রসিদ্ধ। আবু সালামার (রা) পিতামহ হিলাল এবং উম্মু সালামার (রা) পিতামহ মুগীরা দুই ভাই। আবু সালামার পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফুফা। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফুফু বুররাকে তিনি বিয়ে করেন। তাঁরই ছেলে সালামা (রা)। হযরত আবু তালিব, হযরত হাযমা (রা) ও হযরত আববাস (রা) আবু সালামার সম্মাণিত মামা। অন্যদিকে আবু সালামা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুধ ভাই।



তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ছিলেন ঐ সকল লোকদের অন্তর্গত যাঁদেরকে বলা হয় কাদীমুল ইসলাম’ বা প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী। ইসলামের সূচনা পর্বে যখন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে কি করবে না-এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং যখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল একটিদুরুহ কাজ তখন এই দম্পতি ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন। ইবনুল আসীর লিখেছেন, আবু সালামা ইবন আবদিল আসাদ, আবু উবাইদা ইবনুল হারিস, আরকাম ইবন আবী আরকাম, উসমান ইবন মাজ‘উন-এঁরা সকলে এক সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। এঁদের পরে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ, সা‘ঈদ ইবন যায়িদ ও অন্যরা মুসলিম হন।



ইসলাম গ্রহণের পর বনু মাখযুম হযরত আবু সালামার (রা) উপর নির্দয়ভাবে অত্যাচার উৎপীড়ন চালাতে থাকেন এক পর্যায়ে তিনি পালিয়ে হযরত আবু তালিবের আশ্রয়ে চলে আসেন। বনু মাখযুমের লোকেরা বললোঃ আবু তালিব! এতদিন আপনি আপনার ভাতিজার সাহায্য-সমর্থন করেছিলেন, এখন আপনার আশ্রয়ে থাকা আমাদের ভাইয়ের ছেলেকেও আমাদের হাতে সমর্পণ করছেন না। আবু তালিব বললেনঃ যে বিপদ থেকে আমার ভাইয়ের ছেরেকে রক্ষা করছি, সেই একই বিপদ থেকে আমার বোনের ছেলেকেও রক্ষা করছি। হিজরাতের হুকুম হলে তিনি হাবশায় হিজরাত করেন। ইবন ইসহাক বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম সস্ত্রীক হাবশায় হিজরাত করেন। --##--



**** হিজরাত

ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে যেমন দু’জন একসাথে সিদ্ধান্ত নেন তেমনি হিজরাতের ব্যাপারেও তাঁরা এক সাথে ও একমতে ছিলেন। পরপর দুইবার তাঁরা হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে কিছু দিন অবস্থান করার পর তাঁরা আবার মক্কায় ফিরে আসেন। তারপর আবার মদীনার দিকে যাত্রা করেন। মদীনায় হিজরাতের সময় হযরত উম্মু সালামা (রা) যে হৃদয় বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হন তা তাঁরই ভাষায় ইবনুল আসীর তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ



‘‘আবু সালামা যখন মদীনায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তাঁর কাছে মাত্র একটি উট ছিল। তিনি সেই উটের উপর আমাকে ও তাঁর ছেলে সালামকে উঠান এবং নিজে উটের লাগাম ধরে চলতে আরম্ভ করেন। আমার পিতৃকূল বুন মুগীরার লোকেরা আবু সালামকে বাধা দিয়ে বললো, আমরা আমাদের মেয়েকে এমন খারাপ অবস্থায় যেতে দেব না। আবু সালামার হাত থেকে তারা উটের গালাম ছিনিয়ে নিল এবং আমাকে তারা সংগে করে নিয়ে চলরো। ইতোমধ্যে আমার স্বামীর খান্দান আবু আবদিল আসাদের লোকেরা এসে পড়ে এবং তারা আমার সন্তান সালামাকে তাদের দখলে নিয়ে নেয়। তারা বুন মুগীরাকে বললো, তোমরা যদি তোমাদের মেয়েকে তার স্বামীর সাথে যেতে না দাও তাহলে আমরা আমাদের সন্তানকে তোমাদের মেয়ের কাছে থাকতে দেব না। এভাবে আমি, আমার স্বামী ও আমার সন্তান-তিনজন তিনদিকে ছিটকে পড়রাম। স্বামী-সন্তানের বিচ্ছেদ ব্যথায় আমার অবস্থা খুবই কাহিল হয়ে পড়লো। যেহেতু হিজরাতের নির্দেশ এসেছিল, তাই আবু সালামা মদীনায় পৌঁছে যান। আর এদিকে মক্কায় আমি একাকিনী। প্রতিদিন সকালে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম এবং আবতাহ উপত্যকায় একটি টিলার উপর বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঁদতাম। এভাবে প্রায় সাত/আটদিন চলে যায়।



একদিন আমাদের হিতাকাঙ্খী বনু মুগীরার এক ব্যক্তি আমার এ দুরবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট পেলেন। তিনি বনু মুগীরার লোকদের একত্র করে তাদের সন্ধোধন করে বললেনঃ ‘আপনারা এ অসহায় মেয়েটিকে মুক্তি দিচ্ছেন না কেন? তাকে কেন তার স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন? তাকে মুক্তি দিন এবং স্বামী-সন্তানের সাথে মিলিত হতে দিন।’ তিনি কথাগুলি এমন আবেগভরা শব্দে প্রকাশ করেন যে, তাতে আমার পিতৃগোত্রের লোকদের অন্তরে দয়া ও করুণার সঞ্চায় হয়। তাঁরা আমাকে আমার স্বামীর কাছ যাওয়ার অনুমতি দেন। এ খবর শুনে বনু ‘আবদিল আসাদও আমার সন্তানটিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এখন আমি উটের উপর হাওদায় বসলাম এবং সালামাকে কোলে করে সওয়ার হয়ে গেলাম। মক্কা থেকে একাকিনী বের হয়ে তান‘ঈম পৌঁছালাম। সেখানে কা‘বার চাবি রক্ষক উসমান ইবন তালহা ইবন আবী তালহার সাথে দেখা হলো। তিনি আমার ইচ্ছার কথা জেনে, আমার সাথে আর কেউ আছে কিনা তা জানতে চাইলেন। বললাম, না, আর কেউ নেই। শুধু আমি ও আমার এ শিশু সন্তান। একথা শুনে তিনি আমার উটের লাগাম মুট করে ধরে টানতে টানতে উটের আগে আগে চলতে লাগলেন।



আল্লাহ জানেন, আমি তালহার চেয়ে বেশি ভালো ও ভদ্র মানুষ আরবে আর কাউকে পাইনি। যখন আমরা কোন মানযিলে পৌঁছতাম, এবং আমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন পড়তো, তিনি উট বসিয়ে দিয়ে দূরে কোন গাছের আড়ালে চলে যেতেন। আবার চলার সময় হলে, তিনি উট প্রস্ত্তত করে আমার কাছে এসে বলতেন, উটে বস।’ আমি উটের পিঠে আরাম করে বসার পর তিনি লাগাম ধরে আগে আগে চলতে থাকতেন। গোটা ভ্রমণটাই এই নিয়মে হয়েছিল। যখন আমরা মদীনায় বনু ‘আমর ইবন আওফের পল্লী কুবায় পৌঁছলাম, ‘উসমান ইবন তাহলা আমাকে বললেন, তোমার স্বামী এই পল্লীতে আছেন। আবু সালামা সেখানে অবস্থান করছিলেন। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে মহল্লায় মধ্যে ঢুকে গেলাম এবং আবু সালামার দেখা পেলে গেলাম। এভাবে উসমান ইবন তালহা আমাকে আবু সালাম। সন্ধান দিয়ে আবার মক্কার দিকে যাত্রা করেন।



‘উসমান ইবন তালহার এই সহানুভূতি ও সহমর্মিতার কথা হযরত উম্মু সালামা (রা) সারা জীবন মনে রেখেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেনঃ



-‘আমি উসমান ইবন তালহার চেয়ে বেশি ভদ্র সঙ্গী আর কখনও দেখিনি।’



এই পরীক্ষাপর্বে চারিদিক থেকে মুসলমানরা নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছিল এবং তাদের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার কোন অন্ত ছিল না। হিজরাতের সময় উম্মু সালামাকে যে দুর্ভোগ পেহাতে হয় এ তারই কিছু অংশমাত্র। তাঁর নিজের অন্তরেও এ উপলদ্ধি ছিল। তাই পরবর্তীকালে হিজরাতের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি একটু গর্বের সঙ্গে বলতেনঃ ‘ইসলামের জন্য আবু সালামার পরিবারকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, আহলে বাইতের আর কেউ তেমন পোহায়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।



অন্যান্য গুণে হযরত উম্মু সালামা (রা) যেমন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য বিবিগণের উপর প্রাধান্যযোগ্য ছিলেন, তেমনি ভাবে এ বৈশিষ্ট্যও । করেন যে, তিনিই প্রথম পর্দান শীল মহিলা যিনি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন।



হযরত উম্মু সালামা (রা) প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। তাঁর পিতা আবু উমাইয়্যা ছিলেন কুরাইশদের একজন ক্যাতিমান ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। উম্মু সালামা (রা) যখন কুবায় পৌঁছেন তখন লোকেরা তাঁর পরিচয় জানতে চাইতো। তিনি পিতার নাম বললে কেউ বিশ্বাস করতে চাইতো না। কারণ, সে যুগেও তাঁর মত কোন সম্ভ্রান্ত মহিলা একাকী এভাবে ভ্রমণ করে বিরত থাকতো। উম্মু সালামার ছিল ইসলামের প্রতি প্রচন্ড দরদ এবং আল্লাহর নির্দেশ পালন তিনি অপরিহার্য বলে বিশআস করতেন। এ কারণে তিনিকারও কোন কথায কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করতেন না। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতেন। হজ্জের মওসুম এসে গেল। যখন কিছু লোক কুবা থেকে হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা দিল, তিনি তাদেরকে মক্কায় পিতার ঠিকানা দিলেন। তখন সবাই তার শরাফতী ও খান্দানী আভিজাত্য বিশ্বাস করলো। সবার অন্তরে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার আসন লাভ করলেন।



হিজরাতের দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার দগদগে স্মৃতি তখনও তাঁদের মন থেকে মুছে যায়নি এবঙ স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ এক সাথে বসবাসের সুযোগও বেশি দিন হয়নি, এরই মধ্যে উহুদ যুদ্ধের ডাক এসে যায় এবং হযরত আবু সালামা (রা) সেই ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধে একই নামের প্রতিপক্ষের অপর এক ব্যক্তি আবু সালামা হাশমীর নিক্ষিপ্ত একটি তীরে তাঁর বাহু আহত হয় এবং এক মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যান।২০ এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কাতান’ অভিযানে পাঠান এবং ২৯ দিন সেখানে অতিবাহিত হয়। হিজরী ৪র্থ সনের সফর মাসের আট অথবা নয় তাখি মদদীনায় ফিরে আসেন। তখন তাঁর সেই পুরানো ক্ষত আবার তাজা হয়ে জীবন আশঙ্কা দেখা দেয়। সেই বছর জামাদিউস সানী মাসের নয় তাখি তিনি ইনতিকাল করেন।২১ হযরত উম্মু সালামা (রা) স্বামীর মৃত্যুর খবর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিতে আসেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামার গৃহে যান। উম্মু সালামা তখন শোকে বিহবল। তিনি বারবার মুধু বলছিলেনঃ ‘হায়, বিদেশ-বিভ্রয়ে এ তাঁর কেমন মৃত্যু হলো!’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিয়ে বলেন, তোমরা তাঁর মাগফিরাত কামনা করে দু‘আ কর। আর বল-



‘হে আল্লাহ, আমাকে তাঁর চেয়ে ভালো কোন বিকল্প দান দরুন।’



তারপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু সালামার লাশেল কাছে যান এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন। সেই নামাযে তিনি নয়টি তাকবীর বলেন। লোকেরা মনে করেছিলেন হয়তো ভুর হয়েছে। তাই তাঁরা বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনার ভুল হয়নি তো? বললেনঃ এ ব্যক্তি তাঁরা তাকবীর লাভের যোগ্য ছিলেন। মৃত্যুর সময় আবু সালামার চোখ দুইটি খোলা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের দুইটি পবিত্র হাত দিয়ে চোখ দুইটি বন্ধ করে দেন এবং তাঁর মাগফিরাত কামনা করে দু’আর করেন। --##--



**** দ্বিতীয় বিয়ে:

হযরত আবু সালামার (রা) যখন ইনতিকাল হয় তখন হযরত উম্মু সালামা সন্তানসম্ভবা। সন্তান প্রসবের পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) তাঁর একাকীত্ব ও দুঃখ-বেদনার কথা চিন্তা করে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। হযরত উম্মু সালামা (রা) এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।



একটি বর্ণনায় একথাও এসেছে যে, হযরত ‘উমারও (রা) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থকারের ধারণা যে, উমারের (রা) মাধ্যমে হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিয়ের পয়গাম পাঠান। হযরত আবু সালামার আত্মাত্যাগ এবং হযরত উম্মু সালামার (রা) অসহায় অবস্থা ও একাকীত্ব হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুভূতিকে তীব্রভাবে নাড়া দিতে থাকবে। তাই হযরত আবু বকরের (রা) প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লাহ পাকের নির্দেশে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত উমারের (রা) মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠান। হযরত উম্মু সালামা (রা) কতকগুলি কারণ উল্লেখ করে রাসূরুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাব গ্রহণ করতে অপারপতা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামার (রা) সকল শর্ত মেনে নেন। তখন উম্মু সালামা (রা) রাজি হয়ে যান। উম্মু সালামার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রস্তাব কবুল করতে অপারগতার যে কারণগুলি দেখান তা এরকমঃ (ক) আমি ভীষণ আত্মামর্যাদাবোধসম্পন্ন মহিলা, (খ) আমার কয়েকটি সন্তান রয়েছে, (গ) আমি একজন বয়স্ক মহিলা, (ঘ) আমার কোন ওলী নেই। জবাবোসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমার সন্তানদের দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। তোমার প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ আল্লাহ দূর করে দেবেন। ওলী, তা তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে রাজি হবে না, আর তুমি বয়স্কা, তোমার চেয়ে আমার বয়স বেশি।



তারপর তিনি ছেলে ‘উমারকে বলেনঃ ‘যাও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে আমর বিয়ের ব্যবস্থা কর।



হিজরী ৪র্থ সনের শাওয়াল মাসের শেষের দিকে হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। স্বামী আবু সালামার (রা) মৃত্যুতে তিনি যে দুঃখ বেদনার শিকার হন, এভাবে তা দূর হয় এবং তাঁর চেয়ে ভালো বিকল্প লাভ করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দুঃখকে অনন্তকালের জন্য আনন্দে রূপান্তর করে দেন।



আহমাদ ইবন ইসহাক হাদরামী, যিয়াদ ইবন মারইয়ারেম সূত্রে বর্ণনা করেছেন। একবার উম্মু সালামার স্বামী আবু সালামাকে বলেনঃ আমি জেনেছি, যদি কোন মহিলার স্বামী মৃত্যুর পর জান্নাতে যায়, আর তার স্ত্রী-দ্বিতীয় বিয়ে না করে তাহলে আল্লাহ সে স্ত্রীকেও স্বামীর সাথে জান্নাতে স্থান দান করবেন। এই অবস্থা পুরুষের জন্যও যদি হয়, তাহলে আসুন আমরা অঙ্গীকার করি, আপনি আমার পআের বিয়ে করবেন না, আর আমিও আপনার পরে আর বিয়ে করবো না। আবু সালামা বলেনঃ তুমি কি আমার কথা মানবে? উম্মু সালামা বললেন, আপনার কথা মানা ছাড়া আমার আনন্দ আর কোথায়? আবু সালামা বললেনঃ আমি যদিতোমার আগে মারা যাই, তুমি আবার বিয়ে করবে। তারপর আবু সালামা দু‘আ করেনঃ ‘হে আল্লাহ, আমার পরে উম্মু সালামাকে আমার চেয়েও ভালো পাত্র দান করুন।’ হযরত উম্মু সালামা (রা) বলেনঃ যখন আবু সালামা মারা গেলেন, তখন আমি মনে মনে বলতাম, আবু সালামার চেয়ে ভালো আর কে হবে? এর কিছুদিন পরেই রাসূলুল্লাহর (রা) সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।



উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা এই দম্পতির মধ্য এক মধুর সম্পর্কের কথা যেমন জানা যায়, তেমনি একথাও জানা যায় যে, ইসলামের সঠিক ও পরিচ্ছন্ন শিক্সার প্রভাব কত গভীর ছিল। যার পলে একজন স্বামী তাঁর সকল আবেগ দমন করে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে তার অবর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ের উপদেশ দিতে সক্ষম হয়েছে।



হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজোড়া যাঁতা, দুইটি মশক, এবং চামড়ার কভার ও খোরমার ছালে ভরা একটি বালিশ উম্মু সালামাকে (রা) দেন। এ সকল জিনিসই তিনি অন্য বিবগণকেও দিয়েছিলেন।



হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামাকে বিয়ে করার পর তাঁর রূপ ও সৌন্দর্যের কথা হযরত ‘আয়িশার (রা) কানে গেলে তাঁর মনের মধ্যে একটু ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। তিনি উম্মু সালামাকে (রা) দেখতে আসেন। গভীরভাবে দেখার পর তিনি বুঝতে পারলেন, উম্মু সালামার (রা) রূপের কথা যতটুকু বলা হয়, তিনি তার চেয়েও বেশি সুন্দরী। তিনি তাঁর রূপের কথা হযরত হাফসাকে (রা) বললেন। হাফসা (রা) আয়িশাকে (রা) বুঝালেন যে, লোকে একটু বাড়িয়ে বলছে। তারপর হযরত হাফসা (রা) তাঁকে দেখেন এবং একই কথা বলেন। হযরত ‘আয়িশা (রা) আবার তীক্ষ্ণভাবে উম্মু সালামাকে (রা) দেখেন এবং হাফসার (রা) একই ঠিক বলে বিশ্বাস করেন। যাই হোক, এ বর্ণনা এবং এ ধরনের আরও বহু বর্ণনা দ্বারা হযরত উম্মু সালামার (রা) সুদর্শন চেহারার প্রমাণ পাওয়া যায়।



হযরত উম্মু সালামা (রা) ছিলেন একজন লজ্জাবতী ও প্রখর আত্মমর্যাবোধসম্পন্ন মহিলা। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বিয়ের পর প্রথমদিকে তাঁরা অবস্থা এমন ছিল যে, যখনই রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসতেন, তিনি দুগ্ধপোষ্য মেয়ে যায়নাবকে দুধ পান করাতে শুরু করতেন। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিরে যেতেন। হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) ছিলেন তাঁর দুধভাই। তিনি একথা শুনে ক্ষেপে যান এবং মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যান। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামার ঘরে আসেন এবং এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন। শিশু মেয়েকে না দেখে জিজ্ঞেস করেনঃ যায়নাব কোথায়? তাকে কি করেছো? তিনি জাব দিলেনঃ ‘আম্মার এসে নিয়ে গেছে। সেদিন থেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থান করতে থাকেন।



ধীরে ধীরে এ অবস্থা দূর হয়ে যায় এবং অন্য বিবিগণ যেভাবে ছিলেন সেভাবে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সম্পর্ক এত গভীর হয় যে, হযরত আয়িশার (রা) পরেই তাঁর স্থান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।



হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হযরত উম্মু সালামার (রা) বিয়ের ঘটনাসমূহের মধ্যে এ ঘটনা বিশেস উল্লেখযোগ্য যে, যেদিন তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে আসেন সেদিই নিজ হাতে খাবার তৈরি করেন। হযরত যায়নাব বিনত খুযায়তমা (রা) অল্প কিছুদিন আগে ইনতিকাল করেছিলেন। উম্মু সালামাকে তাঁরই ঘরে এনে উঠানো হয়। ঘর-গৃহস্থালীর জিনিসপত্র আগে থেকেই প্রস্ত্তত ছিল। হযরত উম্মু সালামার (রা) একটি কলস থেকে কিছু যব বের করেনএবং অন্য একটি পাত্র থেকে কিছু চর্বি বের করে একটি হাড়িতে চড়িয়ে দেন। তারপর যবগুলি যাঁতায় পিষে চর্বিতে মিশিয়ে এক প্রকার খাবার তৈরি করেন। তাই ছিল হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর জীবন সঙ্গিনীর বাসর রাতের খাদ্য।



হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবিগণের দুইটি দল ছিল। একদলে ছিলেন হযরত আয়িশা (রা), হযরত হাফসা (রা), হযরত সাফিয়্যা (রা) ও সাওদা (রা)। আর দলে ছিলেন হযরত উম্মু সালামা (রা) ও অন্যরা। ‘আয়িশা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী। লোকেরা তা জানতো। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেদিন আয়িশার (রা) ঘরে থাকতেন, সেদিন তাঁরা হাদিয়া তোহফা পাঠাতো। উম্মু সালামার (রা) দলের বিবিগণ বললেন, আমরাও আয়িশার মতহাদিয়া তোহফা পেতে চাই। সুতরাং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যার ঘরেই থাকুন না কেন, লোকদের সেখানেই যা কিছু পাঠবার পাঠানো উচিত। তাঁরা তাঁদের দাবির কথা রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানানোর জন্য উম্মু সালামাকে সুখপাত্রী মনোনীত করেন।



হযরত উস্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাটি পর পর দুইবার বলেন। তিনি উপেক্ষা কররেন। তৃতীয়বাবেরর মাথায় বললেনঃ ‘আয়িশার ব্যাপারে তোমরা আমাকে কষ্ট দিও না। কারণ, সে ছাড়া তোমাদের মধ্যে এমন কেউ সেই যার লেপের মধ্যে আমার নিকট ওহী এসেছে।



উম্মু সালামা (রা) তখন বললেনঃ

-ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনাকে কষ্টদানের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করছি।



রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের অভাব ও দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েই সন্তুষ্টচিত্তে তাঁর সাথে জীবন কাটিয়েছেন। একবার হযরত আল-‘ইরবাদ, জু‘আল ইবন সুরাকা ও আবদুল্লাহ ইবন মুগাফফিল (রা) কোন এক সফর থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আসলেন। তাঁরা ছিলেন অভুক্ত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে কিছু আহার করানোর ইচ্ছায় উম্মু সালামার (রা) নিকট গেলেন এবং কিছু খাবার চাইলেন। কিন্তু তাঁর ঘরে খাবার মত কিছুই পেলেন না।



আল-মুত্তালিব ইবন আবদিল্লাহ বলেনঃ আরবের কিধবা উম্মু সালমা সন্ধ্যার প্রথম পর্বে সাইয়্যেদুল মুসলিমীনের ঘরে বউ হিসেবে আসেন এবং রাতের শেষ পর্বে যব পিষতে লেগে যান।



হিজরী ৫ম সনে মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জার অবরোধের এক পর্যায়ে তাদের সাথে আলোচনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু লুবাবাকে (রা) পাঠান। তাদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি হাতের ইঙ্গিতে তাদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে, তোমাদের হত্যা করা হবে। কিন্তু এটাকে রাসূলুল্লারহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোপন কথা ফাঁস করে দেয়া হয়েছে মনে করে ভীষণ অনুতপ্ত হন। তারপর তিনি মসজিদের একটি খুঁটিতে নিজেকে বেঁধে ফেলেন। অনেকদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে এ অবস্থায় রাখেন, অতঃপর তাঁর তাওবা কবুল হয়। সেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামার (রা) ঘরে ছিলেন।



সকালে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সালামার (রা) ঘরে ঘুম থেকে জেগে মৃদু হাসতে থাকেন। হযরত উম্মু সালামা (রা) তা দেখে বলেনঃ আল্লাহ আপনাকে সর্বদা হাসিতে রাখুন। এ সময় হাসির কারণ কি? বললেনঃ আবু লুবাবার তাওবা কবুল হয়েছে। হযরত উম্মু সালামা তাঁকে এ খোশখবরটি শোনাবার অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হাঁ, চাইলে শোনাতে পার। উম্মু সালামার ঘরটি ছির মসজিদে নববীর এত নিকটে যে, ঘর থেকে আওয়ায দিলে মসজিদ থেকে শোনা যেত। অনুমতি পেয়ে তিনি হুজরার দরজায়। দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠেনঃ আবু লুবাবা! তোমাকে মুবারকবারদ। তোমার তাওবা কবুল হয়েছে। এ আওয়ায মানুষের কানে যেতেই গোটা মদীনা যেন আনন্দ-উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।



এটা হিজাবের হুকুম নাযিলের আগেন ঘটনা।



সেই বছর হিজাবের (পর্দা) আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াত নাযিলের আগ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবিগণ কিছু কিছু দূরের আত্মীয়-স্বজনদের সামনে যেতেন। এখন কিছু বেশষ আত্মীয় ও আপনজন ছাড়া সবার থেকে পর্দা করার নির্দেশ হলো। হযরত ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন কুরাইশ বংশের একজন অতিমর্যাদাবান অন্ধ সাহাবী। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মু‘য়াজ্জিনও ছিলেন। যেহেতু তিনি অন্ধ ছিলেন, এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্দর মহলেও তাঁর যাতায়াত ছিল। হিজাবের আয়াত নাযিলের পর পূর্বের অভ্যাস মত একদিন তিনি ভিতরে প্রবেশ কররেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত উম্মু সালামা (রা) ও হরত মায়মূনাকে (রা) বললেনঃ ‘তার থেকে তোমরা পর্দা কর।’ তাঁর বললেনঃ তিনি তো একজন অন্ধ মানুষ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা তো আর অন্ধ নও। তোমরা তো তাকে দেখছো।



খন্দক যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এত নিকটে ছিলেন যে, তাঁর প্রতিটি কথা ভালোমত শুনতে পেতেন। তিনি বলতেন, আমার সেই সময়ের কথা খুব ভালো মনে আছে, যখন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পবিত্র বুকে ধুলোবলি লেগে ছিল। তিনি লোকদের মাথায় ইট উঠিয়ে দিচ্ছিলেন আর কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। হঠ্যাৎ আম্মার ইবন ইয়াসিরের প্রতি দৃষ্টি পড়লে তিনি বললেনঃ হে ইবন সুমাইয়্যা, তোমাকে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে।



হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় হযতর উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি সঠিক পরামর্শ দান করেছিলেন। সহীহ আল বুখারীতে এসেছে, সন্ধি চুক্তির পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, লোকেরা যেন হুদাইবিয়ায় নিজ নিজ পশু কুরবানী করে। যেহেতু সন্ধির শর্তাবলী দৃশ্যত মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ছিল। এ কারণে সাধারণভাবে মুসলমানরা মনঃক্ষুণ্ণ ও বিমর্ষ ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার নির্দেশ দানের পরেও কারও মধ্রে নির্দেশ পালনের তোড়জোড় দেখা গেল না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাবুতে ফিরে এসে উম্মু সালামার (রা) নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তখন উম্মু সালামা বলেনঃ ‘আপনি কাকেও কিছু বলবেন না। বাইরে যেয়ে নিজের কুরবানী করুন এবং ইহরাম ভাঙ্গার জন্য মাথার চুল ফেলে দিন।’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরামর্শ মত কাজ করেন। লোকেরা যখন দেখলো রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নির্দেশ মত নিজেই আমল করছেন তখন সবাই কুরবানী করে ইহরাম ভেঙ্গে ফেলে। তখন কুরবানী করা ও ইহরাম ভাঙ্গার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।



হযরত উম্মু সালামা (রা) এ পরামর্শ ছিল খুবই সময় উপযোগী ও বাস্তবসম্মত। যা এক কঠিন সমস্যাকে নিমেষেই সমাধান করে দেয়।



হিজরী ৯ম সনের ইলা ও তাখঈর-এর ঘটনার সময় হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমার (রা) নিজ নিজ মেয়েকে উপদেশ দেন। হযরত উমার (রা) উম্মু সালামার কাছে এসে কথা বলেন। হযরত উম্মু সালামা (রা) একটু কর্কশ কণ্ঠে তাঁকে বলেনঃ



-ইবন খাত্তাব! এ আশ্চর্যের ব্যাপার যে, আপনি প্রত্যেকটি ব্যাপারে নাক গলান। এমনকি আপনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর বিবিগণের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারেও নাক গলাতে শুরু করেছেন।



হযরত ‘আয়িশার (রা) জীবনকথা’র আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। হযরত উম্মু সালামা (রা) জবাবটি ছিল বড় শক্ত। তাই হযরত উমার (রা) নীরবে উঠে চলে যান। এদিকে রাতের মধ্রে খবর রটে যায় যে, হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বিবিগণকে তালাক দান করেছেন। সকালে হযরত উমার (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট উপস্থিত হয়ে সকল ঘটনা তাঁকে বলেন। উম্মু সালামার (রা) শক্ত জবাবের কথা শুনে তিনি মৃদু হেসে দেন।



মক্কা বিজয়ের সময় হযরত উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গিনী ছিলেন। কাফেলা যখন মক্কার অদূরে মাররুজ জাহরান মতান্তরে নীকুল ওকাব নায়ক স্থানে তখন রাতের অন্ধকারে মক্কার আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন আবী উমাইয়্যা ইবনুল মুগীরা মুসলমান শিবিরে উপস্থিত হন এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। এ সময় উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরামর্শ দেন এভাবেঃ



-ইয়া রাসূলাল্লাহ! একজন আপনার চাচার ছেলে, আর একজন আপনার ফুফুর ছেলে ও আপনার শালা।’ উল্লেখ্য যে, আবু সুফইয়ান রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বড় চাচা আল হারিসের ছেলে, আর আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফুফু আতিকার ছেলে এবং উম্মু সালামার (রা) ভাই।



তায়িফ অভিযানের সময় হযরত উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঙ্গে ছিলেন। হিজরী ১০ম সনে বিদায় হজ্জের সময় হযরত উম্মু সালামা (রা) অসুস্থ ছিলেন। কিনউত একটি দীনী ফরয কাজ আদায়ে কোন রকম শিথিলতা তাঁর পছন্দ হয়নি, তাই সঠিক ওজর বা কারণ থাকা সত্ত্বেও তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফরসঙঙ্গীন হন। তাওয়াফের ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেনঃ উম্মু সালামা! যখন ফজর নামাযের সময় হতে থাকবে তুমি উটের উপর সওয়ার হয়ে তাওয়াফে করে নিবে। তিনি তাই করেছিলেন।৪০ হিজরী একাদশ সনে হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের শেষ দিনগুলিতে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হযরত আয়িশার (রা) ঘরে অবস্থান করতে থাকেন তখন হযরত উম্মু সালামা (রা) প্রায়ই রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতে আসতেন। একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তিনি নিজেকে সামলাতে পরলেন না। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠরেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করে বললেনঃ এটা মুসলমানদের আদর্শ নয়।



এ সময় একদিন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসুখ বেড়ে যায়। বিবিগণ তাঁকে দুধ পান করাতে চান। পান করার ইচ্ছে না থাকায় অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু যখন তিনি একটুাচেতন হয়ে পড়েন তখন উম্মু সালামা ও উম্মু হাবীবা (রা) জোর করে মুখ হা করে সামান্য পান করিয়ে দেন।



এ সময় এদনি উম্মু সালামা (রা) ও উম্মু হাবীবা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট হাবশার খ্রিস্টানদের উপাসনালয়ে মানুষের মৃর্তির ছবি রাখার আলোচনা করলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাদের মধ্রে কোন নেককার লোক মারা গেলতোরা তার কবরকে উপাসনালয় বানিয়ে নেয় এবং তাদের মূর্তি তৈরি করে তার মধ্যে স্থাপন করে। কিয়ামতের দিন এই লোকরা হবে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।



হযরত হুসাইনের (রা) শাহাদাতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত উম্মু সালামা (রা) নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। হযরত হুমাইন (রা) যে সময় ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে চলেছেন, ঠিক সেই সময় হযরত উম্মু সালামা (রা) স্বপ্নে দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসেছেন। তিনি ভীষণ অস্থির।াথা ও দাডিড় মুবারক ধুলিমলিন। উম্মুস সালামা (রা) জিজ্ঞেস কররেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ। এ অবস্থা কেন? বরলেনঃ ‘হুসাইনের শাহাদাত স্থর থেকে ফিরে আসছি।’ ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ থেকে অশ্রু ঝতে লাগলো। এ অবস্থায় তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, ইরাকীরা হুসাইনকে সত্যা করেছে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন! হুসাইনকে তারা অপমান করেছে, তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক। --##--



**** সন্তান

হযরত উম্মু সালামা (রা) সকল ছেলে-মেয়ে প্রথম স্বামীর। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে তাঁর কোন সন্তান হয়নি। আল-ইসাবা, উসুদুল গাবা ও তাবাকাতে সারামা ও ‘উমার-দুই ছেলে এবং যায়নাব নামের এক মেয়ের বর্ণনা এসেছে। সহীহ আল বুখারীতে ‘দুররা’ নামে একটি মেয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। এই হিসেবে হযরত উম্মু সালামার (রা) সন্তান সংখ্যা চারজন হয়। নিম্নে সংক্ষেপে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ



সালামাঃ হাবশায় জন্মগ্রহণ করেন।৪২ উম্মু সালামার মদীনায় হিজরাতের সময় তিনি কোলে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত হামযার (রা) মেয়ে উমামাকে এ সালামার সাথে বিয়ে দেন।



‘উমারঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের সময় তার বয়স ছির নয় বছর। ডাকনাম ছির আবু হাফস। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের সময় মদীনায় মারা যান। এই ‘উমারের তত্ত্বাবধানে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তাঁর মা উম্মু সালামার বিয়ে সম্পন্ন হয়। হযরত ‘আলীর (রা) খিলাফতকালে তিনি ফারেস ও বাহরাইনের শাসক নিযুক্ত হন। মা তাঁকে উটের যুদ্ধে ‘আলীর (রা) সাথে পাঠান। তিনি ‘আলীকে (রা) বলেন, আমার জানের চেওে প্রিয় সন্তানকে আপনার সাথে পাঠালাম। আপনার সাথে থাকবে, তারপর আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই হবে। যদি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশের খেলাফ না হতো তাহলে আমিও আপনার সাথে বের হতাম। যেমন বের হয়েছেন ‘আয়িশা (রা), তালহা ও যুবাইরের সাথে।



দুররাঃ সহীহ আল বুখারী তার উল্লেখ এসেছে। একদিন হযরত উম্মু হাবীবা (রা) রাসূরুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি শুনেছি আপনি নাকি দুররাকে বিয়ে করতে চান? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তা কি করে হয়? আমি তাকে লালন-পালন না করলেও সে আমার জন্য কোনভাবেই হালাল ছিল না, কারণ, সে আমার দুধ ভাইয়ের মেয়ে।



যায়নাবঃ তাঁর প্রথম নাম ছিল ‘বাররা’। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাখেন যায়নাব। তাঁর এই সন্তানগণের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেন সাহাবিয়্যাতের মর্যাদার অধিকারী হন। --##--



**** আখলাক

হযরত উম্মু সালামার (রা) গোটা জীবনই ছির যুহদ ও তাকওয়ার বাস্তব নমুনা। দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও চাকচিক্যের প্রতি খুব কমই দৃষ্টি দিতেন। একবার তিনি একটি হার গলায় পরেন। হারটিতে সামান্য সোনা ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসস্ত্তষ্টি প্রকাশ করায় তা খুলে ফেলেন।



তিনি প্রতিমাসের প্রতি সোম, বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট তিনদিন রোযা রাখতেন। প্রথম স্বামীর ছেলে-মেয়েরা সঙ্গে ছিল। অতি যত্নের সাথে তাদের লালন-পালন করতেন। একবার রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করেন যে, আমি কি এর কোন সওয়াব পাব? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ, পাবে।’ শরীয়াতের আদেশ-নিষেধের প্রতি অত্যধিক সতর্ক থাকতেন। কিছু লোক একবার নামাযের মুস্তাবাহ ওয়াক্ত ছেড়ে দেয়। উম্মু সালামা তাদের সতর্ক করে দেন এবং বলেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুহরের নামায তাড়াতাড়ি আদায় করতেন, আর তোমরা আসরের নামায তাড়াতাড়ি আদায় করে থাকে?



হযরত উম্মু সালামার (রা) এক ভাতীজা একদিন তার সামনে দুই রাকায়াত নামায পড়রেন। সিজদার স্থানটিতে ধুলোবালি থাকায় তিনি সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে কপাল থেকে মাটি ঝাড়েন। উম্মু সালামা তাঁকে নিষেধ করেন এবং বলেন, এটা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আচরণের পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি দাস একবার এমন করেছিল। তিনি তাঁকে বলেনঃ



আল্লাহর জন্য তোমার চেহারা ধুলিমলিন হোক।



তিনি নিজেও যেমন দানশীল ছিলেন তেমনিান্যকেও দানশীলতার প্রতি উৎসাহ দিতেন। একবার কয়েকজন অভাবী মানুষ তাঁরৃহে এসে সাহায্য প্রার্থনা করে। উম্মুল হুসাইন তাঁর কাছে বসা ছিলেন, তিনি তাদের ধমক দিলেন। কিন্তু উম্মু সালামা তাঁকে থামান এবং বলেন, আমাদের এমন করার আদেশ নেই। তারপর তিনি দাসীকে নির্দেশ দেন, তাদেরকে কিছু দিয়ে বিদেয় করো। যদি কিছু না থাকে তাহলে একটি খোরমা তাদের হাতে দাও।



একবার হযরত আবুদর রহমান ইবন আওফ (রা) তাঁকে বললেনঃ আম্মা! আমার কাছে এত বেশি পরিমাণ অর্থ-সম্পদ জমা হয়ে গেছে যে, আমি আমার ধ্বংসের আশঙ্কা করছি। তিনি বলরেনঃ ছেলে! খরচ করে ফেল! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, অনেক সাহবী এমন আছে যে আমাকে আমার মৃত্যুর পর আর কখনও দেখবে না।



তিনি অন্যের আরাম-আয়েশের প্রতি খুবই সতর্ক থাকতেন। যতদূর সম্ভব ভালো কাজে কার্পণ্য করতেন না। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ভালোবাসার স্মৃতি হিসেবে তাঁর দেহের একটি পশম তিনি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। সহীহ আল বুখারীতে এসেছে, তার কাছে রূপোর একটি পাত্র ছিল, তাতে তিনি পশম মুবারক সংরক্ষণ করেছিলেন। সাহাবীদের দেউ কোন দুঃখ-বেদনা পেলে একপেয়ালা পানি এনে তাঁর সামনে রাখতেন, তিনি পশম মুবারকটি সেই পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিতেন। সেই পানির বরকতে তাঁর সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যেত। আবদুল্লাহ ইবন মাওহাব বলেন, আমি উম্মু সালামার (রা) গোলাম। তিনি ‘হিন্না ও কাতাম;-এ রক্ষিত রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি পশম বের করেন।



যেদিন হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত উম্মু সালামার (রা) ঘরে রাত কাটাতেন, জায়নামাযের সামনে বিছানা করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায আদায় করতেন, আর তিনি সেই বিছানায় শুয়ে থাকতেন।



রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরাম-আয়েশের প্রতি এতই সতর্ক ছিলেন যে, নিজের দাস সাফীনাকে এই শর্তে মুক্ত করে দেন যে, এতদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিত থাকেন তাঁর সেবা করতে হবে।



একবার হযরত উম্মু সালামা (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কী কারণ যে, কুরআনে আমাদের (মেয়েদের) উল্লেখ নেই? এ প্রশ্নের পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদের মিন্বারে উঠে দাঁড়ানে এবং সূরা আল-আহযাবের ৩৫তম আয়াতটি তিলাওয়াত করেনঃ



-নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ধৈর্যশীল নারী বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নরী, রোযা পালনাকরী পুরুষ, রোযা পালনাকরী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাতককারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হিফাতককারী নারী আল্লাহর অধিক জিকরকারী পুরুষ ও জিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্ত্তত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্খার।’ হযরত রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে গভীর সম্পর্ক ও ভালোবাসা থাকার কারণেই হযরত উম্মু সালামা (রা) এমন প্রশ্ন করতে হাসন পান।



হযহর উম্মু সালামার (রা) মহত্ব ও মর্যাদা।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবিগণের মধ্রে মহত্ব ও মর্যাদায় হযরত আয়িশার (রা) পরেই হযরত উম্মু সালামার (রা) স্থান। ইবন হাজার বলেনঃ



-উম্মু সালামা অনুপম সৌন্দর্য, পূর্ণ প্রজ্ঞা ও সঠিক সিদ্ধান্তের গুণে গুণাম্বিতা ছিলেন।



তিনি আবু সালামা, ফাতিমাতুয যাহরা এবং খোর রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যাঁরা উম্মু সালামার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ উমার, যায়নাব (ছেলে-মেয়ে), তাঁর ভাই ‘আমির, ভাইয়ের ছেলে মুস‘আব ইবন ‘আবদিল্লাহ, ‘আবদুল্লাহ ইবন রাফে, নাফে’ ইবন সাফীন, আবু কাসীর, খাযরা, সাফিয়্যা বিনত শায়বা, হিন্দা ইবনুল মুসায়্যিব, হুমাইদ, ‘উরওয়া, আবু বকর ইবন ‘আবদির রহমান, সুলায়মান ইবন ইয়াসার প্রমুখ সাহাবী ও তাবে‘ঈ।৫৫ হাদীসের প্রন্থসমূহে তাঁর ৩৭৮টি হাদীস পাওয়া যায়। তার মধ্যে তেরটি মুত্তাফাক ‘আলাইহি। ইমাম বুখারী তিনটি ও ইমাম মুসলিম তেরটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। এ হিসেবে তিনি মুহাদ্দিস সাহাবীদের তৃতীয় স্তরের অন্তর্ভূক্ত। হাদীস বর্ণনাকারী মহিলাদের মধ্যে একমাত্র হযরত আয়িশা (রা) ছাড়া তাঁর উপরে আর কেউ নেই।



হযরত উম্মু সালামার (রা) হাদীস শোনার প্রবর আগ্রহ ছিল। একদিন তিনিচুলের বেনী বাঁধাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুতবা দানের জন্য মসজিদের মিন্বারে উঠলেন। তিনি কেবল ‘ওহে জনমগুলী!’ বলেছেন, আর অমনি উম্মু সালামা চুল বিন্যস্তকারিণীকে বললেন, ‘চুল বেঁধে দাও’। সে বললে! এত তাড়া কিসের। সবে তো ‘ওহী জনমগুলী!’ বলেছেন। উম্মু সালামা বললেন! খুব ভালো কথা, আমরা কি জনমগুলীর অন্তর্ভূক্ত নই? তারপর তিনি নিজের চুল বেঁধে দ্রুত উঠে যান এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্ণ ভাষণটি শোনেন।



এ ঘটনা দ্বারা তাঁর জ্ঞান অর্জনের প্রতি তীব্র আকাঙক্ষা প্রমাণিত হয়।

হযরত উম্মু সালামার (রা) হাদীসগুলি মুসনাদে ইমাম আহমাদের ৬ষ্ঠ খন্ডের ২৮৯ হতে ৩২৪ পৃষ্ঠাগুরিতে সংকলিত হয়েছে। হযরত উম্মু সালামার (রা) স্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে মাহমূদ ইবন লাবীদ বলেনঃ



-রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবিগণের বহু হাদীস মুখস্থ ছিল। তবে হযরত আয়িশা ও হযরত উম্মু সালামার (রা) কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।



আল্লামা ইবনুল কায়্যিম বলেনঃ যদি তাঁর ফাতওয়া সংগ্রহ করা হয়, তাহলে ছোটখাট একটি পুস্তিকার আকার ধারণ করতে পারে।



ইমামুল হারামাইন বলেনঃ ‘হযরত উম্মু সালামার (রা) চেয়ে বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত দানের অধিকারী কোন নারী আমার নজরে পড়ে না।



মারওয়ান ইবন হাকাম হযরত উম্মু সালামার (রা) নিকট মাসয়ালা জিজ্ঞেস করতেন এবং প্রকাশ্যে বলতেনঃ



-আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবিগণ থাকতে কিভাবে আমরা অন্যদের নিকট জিজ্ঞেস করি?



হযরত আবু হুরাইরা (রা) ও হযরত ইবন আববাস (রা)-যাঁদেরকে বরা হয় জ্ঞানের নাগর, তাঁরাও জানার জন্য হযরত উম্মু সালামার (রা) দরজায় ধর্না দিতেন। তাবে’ঈদের বিরাট একটি দল তাঁর থেকে জ্ঞান অজৃন করেছেন।



হযরত উম্মু সালামা (রা) খুব সুন্দর করে কুরআন তিলাওয়াতকরতে পারতেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কায়দা ও রীতিতে পড়তে পারতেন। একবার কোন এক ব্যক্তি, তাঁর কাছে জানতে চায়ঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিরায়াত পড়তেন কেমন করে? বললেনঃ এক একটি আয়াত পৃথক পৃথক করে পড়তেন। তারপর তিনি নিজেই কিছু আয়াত পাঠ করে শুনিয়ে দেন।



তাঁর মধ্যে দারুণ বিচরক্ষণতা ছিল। হযরত রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পূর্বে কন্যা ফাতিমাকে গোপনে একটি কথা বলেন। হযরত ‘আয়িশার (রা) মত সর্বগুণে গুণাম্বিতা স্ত্রীও তখনই ফাতিমাকে জিজ্ঞেস করে তা জানাতে চান। কিন্তু ফাতিমা (রা) তা বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং আয়িশা (রা) লজ্জিত হন। কিনউত উম্মু সালামা (রা) সেই গোপন কথা জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েননি। তিনি ধৈয্য করে অপেক্ষা করেন এবং রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর জিজ্ঞেস করেন।



সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আযাত, যাঁকে আয়াতের তাতহীর’ বলা হয়, হযরত উম্মু সালামার (রা) ঘরে নাযিল হয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে অবস্থান করছিলেন। আয়াতটি এইঃ



-হে নবী পরিবার সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপরিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পুত-পবিত্র রাখতে।



এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ফাতিমা, হযরত আলী, হযরত হাসান ও হযরত হুসাইনকে (রা) ডেকে আনেন এবং বলেন, এরা আমার আহলে রায়ত বা আমার পরিবারের সদস্য। হযরত উম্মু সালামা (রা) জানতে চাইলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি আহলে বায়তের অন্তর্গত? বললেনঃ আরবী হবে হাঁ, ইনশাআল্লাহ।৬৩ জামে আত-তিরমিযীতে একথাও বর্ণিত হযেছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গকে ডেকে এসে তাঁদের মাথার উপর কম্বল উড়িয়ে দেন এবঙ বলেন, হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বায়ত। এদেরকে আপনি পবিত্র করুন। এ দু‘আ শুনে হযরত উম্মু সালামা বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমিও কি ওদের অন্তর্গত? বললেনঃ তুমি তোমার স্থানেই আছ এবং ভালো আছ।



একদনি হযরত উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে বসে আছেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আ) আসেন এবং কথা বরতে থাকেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করেনঃ তাঁকে চেন? উম্মু সালামা বললেনঃ দাহইয়া আল-কালবী। কিন্তু উম্মু সালামা (রা) যখন ঘটনাটি অন্য রোকদের নিকট বররেন তখন জানলেন, লোকটি দাহইয়া নন, বরং জিবরাঈল (আ)। মূহাদ্দিসদের ধারণা, এটা হিজাবের হুকুম নাযিলের আগের ঘটনা।



তিনি যে ইসলামী শরী‘আতের তত্ত্বজ্ঞানে কতখানি পারদর্শী ছিলেন তা তাঁর জীবনের বহু ঘটনা ও তাঁর কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হলোঃ হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলতেন, রমযান মাসে কেউ অপবিত্র হলো সুবহে সাদিকের পূর্বে তাড়াতাড়ি গোসল করে নিতে হবে। অন্যথায় তার রোযা ভেঙ্গে যাবে।



এক ব্যক্তি হযরত আয়িশা ও হযরত উম্মু সালামার (রা) নিকট আবু হুরাইয়ার কথার সত্যতা জানতে চান। তাঁরা দুইজনই তাঁর কথার প্রতিবাদ করেন এবং বলেন, অপবিত্র অবস্থায় খোদ রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোযা রাখতে দেখা গেছে। আবু হুরাইরা একথা জানতে পেরে খুব অনুতপ্ত হন। তিনি বলেন, আমি কি করবো। ফাদর ইবন আববাস আমাকে এমনই বলেছিলেনঃ কিন্তু একথা স্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে উম্মু সালামা ও আয়িশার (রা) জ্ঞান বেশি।



একবার কতিপয় সাহাবী হযরত উম্মু সালামার (রা) নিকট আবদান করেন যে, আমাদেরকে রাসূলুলত্মাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোপন জীবন সম্পর্কে কিছু বলুনঃ তাঁর প্রকাশ ও গোপন-উভয় জীবনই এক রকম। একথা বলার পর হযরত উম্মু সারামার (রা) অনুভূতি হলো যে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন গোপনকথা ফাঁস করে দেওয়া হলো না তো! অনুতপ্ত হলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এলে সব কথা বরলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি খুব ভালো করেছো।



হযরত আবদুলত্মাহ ইবন যুবাইর (রা) আসরের পর দুই রাকায়াত নামায আদায় করতেন।



একদনি মারওয়ান জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ নামায কেন পড়েন? তিনি জবাব দিলে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পড়তেন। যেহেতু হযরত আবদুলত্মাহ ইবন যুবাইর (রা) এ হাদীস হযরত আয়িশার (রা) সূত্রে জেনেছিলেন, তাই মারওযান তার সত্যত যাচাইয়ের জন্য আয়িশার (রা) নিকট রোক পাঠান। আয়িশা (রা) নিকট লোক গের এবং তাঁকে আয়িশার (রা) কথা বলা হলো। তিনি বরলেন, ‘আর্লাহ আশিয়াকে (রা) মাফ করুন! তিনি আমার কথার ভুল অর্থ করেছেন। আমিতাঁকে কি একথা বলিনি যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ নামায পড়তে বারণ করেছেন।



একবার তিনি এক ব্যক্তিকে একটি মাসয়ালার সমাধান বললেন! রোকটি তাতে তৃপ্ত হলো না। সে তাঁর নিকট থেকে উঠে অন্য বিবিগণের নিকট গেল। সবাই একই জবাব দিলেন লোকটি ফিরে এসে উম্মু সালামাকে (রা) কথাটি জানালো। তিনি তাকে বললেনঃ হাঁ, দাঁড়াও। আমি তোমাকে তৃপ্ত করতে চাই। আমি ঐ বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট থেকে একটি হাদীস শুনেছি।



হযরত উম্মু সালামা (রা) যে খুবই লজ্জাবতী মহিলা ছিলেন হাদীসে বর্ণিত অনেক ঘটনা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়। একবার হযরত উম্মু সালাইম (রা) রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, কোন মহিলা যদি স্বপ্নে দেখে যে তার স্বামী তার সাথে যৌনক্রিয়া কবছে, তাহলে তার উপর কি গোসল ওয়াজিব হবে? পাশেই বসা ছিলেন হযরত উম্মু সালামা (রা)। তিনি বলে উঠলেন, উম্মু সুলাইম! তোমার হাত ধুলিমলিন হোক! রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট গোটা নারী জাতিকে লজ্জায় পেলে দিয়েছো। জবাবে হযরত রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, পানি দেখা গেলে তার উপর গোসল ওয়াবিজ হবে, তখন উম্মু সালামা(রা) প্রশ্ন করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! কি পানি আছে?



খিলাফতে রাশেদার পর উমাইয়্যা খান্দানের শাসক ও তাদের উগ্র সমর্থকরা নবী খান্দানের বিরুদ্ধে, বিশেষত হযরত আলী (রা) সম্পর্কে নানা রকম অশালীন মন্তব্য করতো।ানেকে তাঁকে গালি দিত। উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা) সে সময় জীববিত। তিনি তাদেরকে ঘৃণা করতেন। অনেক সময় প্রতিবাদও করতেন। হযরত আবু আবদিল্লাহ আল জাদালী (রা) বলেন, একদনি আমি হযরত উম্মু সালামার সাথে দেখা করতে গেলাম তিনিআমাকে বললেনঃ তোমাদের মধ্রে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গালি দেওয়া হয়? বললামঃ মা‘আজাল্লাহ (আল্লাহর পানাহ)। তখন তিনি বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আলীকে গালি দিয়েছে সে যেন আমাকে গালি দিয়েছে।



অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, উম্মু সালামা (রা) বলেন, আলী এবং তাকে যারা ভালোবাসে তাদেরকে কি গালি দেওয়া হয় না? অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ভালোবাসতেন।



এ বর্ণনা দ্বারা নবী পরিবারের সদস্যদের প্রতি কত গভীর ভালোবাসা ও দরদ ছিল তা জানা যায়।



হযরত উম্মু সালামা (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিন-রাতের অনেক দু‘আ ও ওজীফা র্বণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতুল ফাজরের পর এই দু‘আ করতেনঃ



-হে আল্লাহঃ আমি আপনার কাছে চাই পবিত্র রিযক, কল্যাণকর জ্ঞান ও কবুলকৃত কর্ম।



তিনি আরও বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলতেনঃ



-বিসমিল্লাহ, তাওয়াককালতু আলাল্লাহি। হে আল্লাহ : আমরা পদক্ষলন, পথভ্রষ্টতা,অত্যাচার করা, অত্যাচারিত হওয়া, কারও উপর বাড়াবাড়ি করা অথবা আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করা থেকে আপনার আশ্রয় চাই।



তিনি আরও বলেছেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রায়ই বলতেনঃ



-হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তরকে আপনার দীনের উপর সুদৃঢ় করে দিন।



তাঁর থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেনঃ



-প্রভু হে! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমার প্রতি সদয় হোন এবং আমাকে সোজা পথ দেখান। --##--



**** মৃত্যু-

তাঁর মৃত্যু সন নিয়ে মতভেদ আছে। আল-ওয়াকিদীর ধারণা, হিজরী ৫৯ সনের শাওয়াল মাসে তিনি মৃত্যুবরণ কনে এবং হযতর আবু হুরাইরা (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। ইবন হিববান বলেন, হিজরী ৬১ সনের শেষ দিকে হুসাইন ইবন আলীর (রা) শাহাদাতের পরে তিনি ইনতিকাল করেন। আবু খায়সামার মতে, ৬০ হিজরীর শেষের দিকে ইয়াযীদ ইবন মু‘য়াবিয়ার খিরাফতকালে তাঁর মুত্যু হয়। কিন্তু হিজরী ৬৩ সনের মতটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। এ বরই হাররার ঘটনা সংঘটিত হয়। অর্থাৎ ইয়াযীদ-এর বাহিনী হযরত আবদুলত্মাহ ইবন যুবাইরের (রা) বাহিনীকে মক্কায় অবরোধ করে এবং মক্কার উপর আক্রমণ চালায়।



মুত্যুর সময় হুযরত উম্মু সালামার (রা) বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। হযরত আবু হুরাইরা (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। নিয়ম অনুযায়ী তৎকালীন মদীনার গভর্নর জানাযার নামায পড়াতেন। ওয়ালীদ ইবন উতবা ছিলেন তখন মদীনার গভর্নর। এই ওয়ালীদ আবু সুফইয়ানের (রা) পৌত্র। মৃত্যুর পূর্বে হযরত উম্মু সালামা (রা) অসীয়াত করে যান যে, ‘ওয়ালীদ মদীনার বাইরে জঙ্গলের দিকে চলে যান এবং জনাযার নামায পড়ানোর জন্য হযরত আবু হুরাইরাকে (রা) পাঠিয়ে দেন। তবে ইমামা আয-যাহাবী একটি বণৃনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আবু হুরাইরার (রা) নামায পড়ানোর কথাটি প্রমাণিত নয়। কাণ তিনি উম্মু সালামার (রা) আগেই মারা যান। হযরত উম্মু সালামাকে (রা) মদীনার আল-বাকী‘

Comments

Popular posts from this blog

হযরত হাফসা (রাঃ)

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা)

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)