হযরত হূদ (আঃ)
হযরত হূদ (আঃ)
হূদ (আঃ)-এর পরিচয় :
হযরত হূদ (আঃ) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ‘আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ-এর পরে কওমে ‘আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। হূদ (আঃ) ছিলেন এদেরই বংশধর। ‘আদ ও ছামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্র সামের বংশধর এবং"নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত।[1] ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের"জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
‘আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হ’তে শুরু করে হাযারামাউত ও ইয়ামন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল।[2] তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদের প্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন। আল্লাহ"তা‘আলা তাদের প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্রবুদ্ধির কারণে এসব নে‘মতই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল। তারা শক্তি মদমত্ত হয়ে ‘আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে’ (ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ"১৫) বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল। তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে নূহ (আঃ)-এর আমলে ফেলে আসা মূর্তিপূজার শিরক-এর পুনরায় প্রচলন ঘটালো। মাত্র কয়েক পুরুষ আগে ঘটে যাওয়া নূহের সর্বগ্রাসী প্লাবনের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। ফলে আল্লাহ পাক তাদের"হেদায়াতের জন্য তাদেরই মধ্য হ’তে হূদ (আঃ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করলেন। উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে।
হযরত হূদ (আঃ) ও কওমে ‘আদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৭টি সূরায় ৭৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[3]
হূদ (আঃ)-এর দাওয়াত :
সূরা আ‘রাফ ৬৫-৭২ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
আর ‘আদ সম্প্রদায়ের নিকটে (আমি প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই হূদকে। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। অতঃপর তোমরা কি আল্লাহভীরু হবে না? (আ‘রাফ ৭/৬৫)। ‘তার সম্প্রদায়ের কাফের নেতারা বলল, আমরা"তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি’ (৬৬)। ‘হূদ বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই। বরং আমি বিশ্বপালকের প্রেরিত একজন রাসূল মাত্র’ (৬৭)। ‘আমি তোমাদের নিকটে প্রতিপালকের পয়গাম"সমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের হিতাকাংখী ও বিশ্বস্ত’ (৬৮)। ‘তোমরা কি আশ্চর্য বোধ করছ যে, তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে তোমাদের থেকেই একজনের নিকটে অহী (যিকর) এসেছে, যাতে সে তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে? তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে"কওমে নূহের পরে নেতৃত্বে অভিষিক্ত করলেন ও তোমাদেরকে বিশালবপু করে সৃষ্টি করলেন। অতএব তোমরা আল্লাহর নে‘মত সমূহ স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (৬৯)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে কেবল এজন্য এসেছ যে, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি, আর আমাদের বাপ-দাদারা"যাদের পূজা করত, তাদেরকে পরিত্যাগ করি? তাহ’লে নিয়ে এস আমাদের কাছে (সেই আযাব), যার দুঃসংবাদ তুমি আমাদের শুনাচ্ছ, যদি তুমি সত্যবাদী হও’ (৭০)। ‘হূদ বলল, তোমাদের উপরে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে শাস্তি ও ক্রোধ অবধারিত হয়ে গেছে। তোমরা কেন আমার সাথে"ঐসব নাম সম্পর্কে বিতর্ক করছ, যেগুলোর নামকরণ তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা করেছ? ঐসব উপাস্যদের সম্পর্কে আল্লাহ কোন প্রমাণ (সুলতান) নাযিল করেননি। অতএব অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি’ (৭১)। ‘অনন্তর আমরা তাকে ও তার সাথীদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে"রক্ষা করলাম এবং যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করেছিল, তাদের মূলোৎপাটন করে দিলাম। বস্ত্ততঃ তারা বিশ্বাসী ছিল না’ (আ‘রাফ ৭/৬৫-৭২)।
অতঃপর সূরা হূদ ৫০-৬০ আয়াতে আল্লাহ উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন নিম্নরূপেঃ
অনুবাদঃ আর ‘আদ জাতির প্রতি (আমরা) তাদের ভাই হূদকে (প্রেরণ করেছিলাম)। সে তাদেরকে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন মা‘বূদ নেই। বস্ত্ততঃ তোমরা সবাই এ ব্যাপারে মিথ্যারোপ করছ’ (হূদ ১১/৫০)। ‘হে আমার জাতি! (আমার এ দাওয়াতের"জন্য) আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না। আমার পারিতোষিক তাঁরই কাছে রয়েছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা কি বুঝ না’? (৫১)। ‘হে আমার কওম! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাও। তিনি আসমান থেকে তোমাদের"উপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন। তোমরা অপরাধীদের ন্যায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (৫২)। ‘তারা বলল, হে হূদ! তুমি আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নিয়ে আসনি, আর আমরাও তোমার কথা মত আমাদের উপাস্যদের বর্জন করতে পারি না। বস্ত্ততঃ"আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসী নই’ (৫৩)। ‘বরং আমরা তো একথাই বলতে চাই যে, আমাদের কোন উপাস্য-দেবতা (তোমার অবিশ্বাসের ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে) তোমার উপরে অশুভ আছর করেছেন। হূদ বলল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি, আর তোমরাও সাক্ষী থাক যে, তাদের থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত,"যাদেরকে তোমরা শরীক করে থাক’ (৫৪) ‘তাঁকে ছাড়া। অতঃপর তোমরা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট করার প্রয়াস চালাও এবং আমাকে কোনরূপ অবকাশ দিয়ো না’ (৫৫)। ‘আমি আল্লাহর উপরে ভরসা করেছি। যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই, যা তাঁর"আয়ত্তাধীন নয়। আমার পালনকর্তা সরল পথে আছেন’ (অর্থাৎ সরল পথের পথিকগণের সাথে আছেন)’ (৫৬)। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে (জেনে রেখ যে,) আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি যা নিয়ে আমি তোমাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছি। আমার প্রভু অন্য কোন জাতিকে তোমাদের"স্থলাভিষিক্ত করবেন, তখন তোমরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা প্রতিটি বস্ত্তর হেফাযতকারী’ (৫৭)। ‘অতঃপর যখন আমাদের আদেশ (গযব) উপস্থিত হ’ল, তখন আমরা নিজ অনুগ্রহে হূদ ও তার সাথী ঈমানদারগণকে মুক্ত করি এবং তাদেরকে এক কঠিন আযাব"থেকে রক্ষা করি’ (৫৮)। ‘এরা ছিল ‘আদ জাতি। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহকে (নিদর্শন সমূহকে) অস্বীকার করেছিল ও তাদের নিকটে প্রেরিত রাসূলগণের অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা উদ্ধত ও হঠকারী ব্যক্তিদের আদেশ পালন করেছিল’ (৫৯)। ‘এ দুনিয়ায় তাদের পিছে পিছে অভিসম্পাৎ"রয়েছে এবং রয়েছে ক্বিয়ামতের দিনেও। জেনে রেখ ‘আদ জাতি তাদের পালনকর্তার সাথে কুফরী করেছে। জেনে রেখ হূদের কওম ‘আদ জাতির জন্য অভিসম্পাৎ’ (হূদ ১১/৫০-৬০)।
হূদ (আঃ) তাঁর জাতিকে তাদের বিলাসোপকরণ ও অন্যায় আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং এতদসত্ত্বেও তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ সমূহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যেমন সূরা শো‘আরায় ১২৮-১৩৯ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,
অনুবাদঃ ‘তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে অযথা নিদর্শন নির্মাণ করছ (২৬/১২৮)? (যেমন সুউচ্চ টাওয়ার, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি)। ‘এবং তোমরা বড় বড় প্রাসাদ সমূহ নির্মাণ করছ, যেন তোমরা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে’ (১২৯)? (যেমন ধনী ব্যক্তিরা দেশে ও বিদেশে"বিনা প্রয়োজনে বড় বড় বাড়ী করে থাকে)। ‘এছাড়া যখন তোমরা কাউকে আঘাত হানো, তখন নিষ্ঠুর-যালেমদের মত আঘাত হেনে থাক (১৩০)’ (বিভিন্ন দেশে পুলিশী নির্যাতনের বিষয়টি স্মরণযোগ্য)। ‘অতএব তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর (১৩১)’। ‘তোমরা ভয় কর সেই মহান"সত্তাকে, যিনি তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন ঐসব বস্ত্ত দ্বারা যা তোমরা জানো’ (১৩২)। ‘তিনি তোমাদের সাহায্য করেছেন গবাদি পশু ও সন্তানাদি দ্বারা (১৩৩)’ ‘এবং উদ্যান ও ঝরণা সমূহ দ্বারা (১৩৪)’। (অতঃপর হূদ (আঃ) কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়ে বললেন,) ‘আমি তোমাদের জন্য"মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করছি’ (১৩৫)। জবাবে কওমের নেতারা বলল, ‘তুমি উপদেশ দাও বা না দাও সবই আমাদের জন্য সমান’ (১৩৬)। ‘তোমার এসব কথাবার্তা পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-অভ্যাস বৈ কিছু নয়’ (১৩৭)। ‘আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হব না’ (১৩৮)। (আল্লাহ বলেন,) ‘অতঃপর (এভাবে)"তারা তাদের নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। ফলে আমিও তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। এর মধ্যে (শিক্ষণীয়) নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (শো‘আরা ২৬/১২৮-১৩৯)।
সূরা হা-মীম সাজদার ১৪-১৬ আয়াতে ‘আদ জাতির অলীক দাবী, অযথা দম্ভ ও তাদের উপরে আপতিত শাস্তির বর্ণনা সমূহ এসেছে এভাবে,
‘...তারা (‘আদ ও ছামূদের লোকেরা) বলেছিল, আমাদের প্রভু ইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা পাঠাতেন। অতএব আমরা তোমাদের আনীত বিষয় অমান্য করলাম’ (৪১/১৪)। ‘অতঃপর ‘আদ-এর লোকেরা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করল এবং বলল, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিধর কে আছে? তারা কি লক্ষ্য করেনি"যে, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্ত্ততঃ তারা আমাদের নিদর্শন সমূহ অস্বীকার করত’ (১৫)। ‘অতঃপর আমরা তাদের উপরে প্রেরণ করলাম ঝঞ্ঝাবায়ু বেশ কয়েকটি অশুভ দিনে, যাতে তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনার কিছু আযাব আস্বাদন"করানো যায়। আর পরকালের আযাব তো আরও লাঞ্ছনাকর। যেদিন তারা কোনরূপ সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৪-১৬)।
সূরা আহক্বাফ ২১-২৬ আয়াতে উক্ত আযাবের ধরন বর্ণিত হয়েছে এভাবে, যেমন আল্লাহ বলেন,
‘আর তুমি ‘আদ-এর ভাই (হূদ)-এর কথা বর্ণনা কর, যখন সে তার কওমকে বালুকাময় উঁচু উপত্যকায় সতর্ক করে বলেছিল, অথচ তার পূর্বে ও পরে অনেক সতর্ককারী গত হয়েছিল, (এই মর্মে যে,) তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ইবাদত কর না। আমি তোমাদের জন্য এক মহাদিবসের শাস্তির"আশংকা করছি’ (আহক্বাফ ৪৬/২১)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্য সমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখতে আগমন করেছ? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তবে আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি?’ (২২)। হূদ বলল, এ জ্ঞান তো স্রেফ আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি"যে বিষয় নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি দেখছি তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়’ (২৩)। অতঃপর তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা সমূহের অভিমুখী দেখল, তখন বলল, এতো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। (হূদ বললেন) বরং এটা সেই বস্ত্ত,"যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু, যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’ (২৪)। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবকিছুকে ধ্বংস করে দেবে। অতঃপর ভোর বেলায় তারা এমন অবস্থা প্রাপ্ত হ’ল যে, শূন্য বাস্ত্তভিটাগুলি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হ’ল না। আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে"এমনি করেই শাস্তি দিয়ে থাকি’ (২৫)। ‘আমি তাদেরকে এমন সব বিষয়ে ক্ষমতা দিয়েছিলাম, যেসব বিষয়ে তোমাদের ক্ষমতা দেইনি। আমি তাদের দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়। কিন্তু সেসব কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় তাদের কোন কাজে আসল না, যখন তারা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার"করল এবং সেই শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করল, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত’ (আহক্বাফ ৪৬/২১-২৬)।
উক্ত বিষয়ে সূরা হা-ক্বক্বাহ ৭-৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘তাদের উপরে প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু প্রবাহিত হয়েছিল সাত রাত্রি ও আট দিবস ব্যাপী অবিরতভাবে। (হে মুহাম্মাদ!) তুমি দেখলে দেখতে পেতে যে, তারা অসার খর্জুর কান্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে রয়েছে’ (৭)। ‘তুমি (এখন) তাদের কোন অস্তিত্ব দেখতে পাও কি’? (হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৭-৮)।
সূরা ফাজ্র ৬-৮ আয়াতে ‘আদ বংশের শৌর্য-বীর্য সম্বন্ধে আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে শুনিয়ে বলেন,
‘আপনি কি জানেন না আপনার প্রভু কিরূপ আচরণ করেছিলেন ‘আদে ইরম (প্রথম ‘আদ) গোত্রের সাথে’? (ফজর ৬) ‘যারা ছিল উঁচু স্তম্ভসমূহের মালিক (৭)। ‘এবং যাদের সমান কাউকে জনপদ সমূহে সৃষ্টি করা হয়নি’ (ফাজ্র ৮৯/৬-৮)।
কওমে ‘আদ-এর প্রতি হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম :
কওমে নূহের প্রতি হযরত নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম এবং কওমে ‘আদ-এর প্রতি হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম প্রায় একই। হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারকথাগুলি সূরা হূদ-এর ৫০, ৫১ ও ৫২ আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, যা এক কথায় বলা যায়- তাওহীদ, তাবলীগ ও ইস্তেগফার।"প্রথমে তিনি নিজ কওমকে তাদের কল্পিত উপাস্যদের ছেড়ে একক উপাস্য আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি ইবাদতের আহবান জানান, যাকে বলা হয় ‘তাওহীদে ইবাদত’। অতঃপর তিনি জনজীবনকে শিরকের আবিলতা ও নানাবিধ কুসংস্কারের পংকিলতা হ’তে মুক্ত করার জন্য"নিঃস্বার্থভাবে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাদের নিকট আল্লাহর বিধানসমূহ পৌঁছে দিতে থাকেন। তাঁর এই দাওয়াত ও তাবলীগ ছিল নিরন্তর ও অবিরত ধারায় এবং যাবতীয় বস্ত্তগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অতঃপর তিনি জনগণকে নিজেদের কুফরী, শেরেকী ও অন্যান্য কবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে"তওবা করার ও আল্লাহর নিকটে একান্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানান।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে সকল নবীই দাওয়াত দিয়েছেন। মূলতঃ উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি। মানুষ যখনই নিজেদের কল্পিত দেব-দেবী ও মূর্তি-প্রতিমাসহ বিভিন্ন উপাস্যের নিকটে মাথা নত করবে ও তাদেরকেই মুক্তির অসীলা"কিংবা সরাসরি মুক্তিদাতা ভাববে, তখনই তার শ্রেষ্ঠত্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। নিকৃষ্ট সৃষ্টি সাপ ও তুলসী গাছ পর্যন্ত তার পূজা পাবে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও তার সেবা বাদ দিয়ে সে নির্জীব মূর্তির সেবায় লিপ্ত হবে। একজন ক্ষুধার্ত ভাইকে বা একটি অসহায় প্রাণীকে"খাদ্য না দিয়ে সে নিজেদের হাতে গড়া অক্ষম-অনড় মূর্তিকে দুধ-কলার নৈবেদ্য পেশ করবে ও পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করবে। এমনকি কল্পিত দেবতাকে খুশী করার জন্য সে নরবলি বা সতীদাহ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। পক্ষান্তরে যখনই একজন মানুষ সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ্কে"তার সৃষ্টিকর্তা, রূযীদাতা, বিপদহন্তা, বিধানদাতা, জীবন ও মরণদাতা হিসাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, তখনই সে অন্য সকল সৃষ্টির প্রতি মিথ্যা আনুগত্য হ’তে মুক্তি পাবে। আল্লাহর গোলামীর অধীনে নিজেকে স্বাধীন ও সৃষ্টির সেরা হিসাবে ভাবতে শুরু করবে। তার সেবার"জন্য সৃষ্ট জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষের সবকিছুর উপরে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সে উদ্বুদ্ধ হবে। তার জ্ঞান ও উপলব্ধি যত বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টজীবের প্রতি তার দায়িত্ববোধ তত উচ্চকিত হবে।
দ্বিতীয়তঃ বস্ত্তগত কোন স্বার্থ ছাড়াই মানুষ যখন কাউকে সৎ পথের দাওয়াত দেয়, তখন তা অন্যের মনে প্রভাব বিস্তার করে। ঐ দাওয়াত যদি তার হৃদয় উৎসারিত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের পথের দাওয়াত হয়, তাহ’লে তা অন্যের হৃদয়ে রেখাপাত করে। সংশোধন"মূলক দাওয়াত প্রথমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা অবশেষে কল্যাণময় ফলাফল নিয়ে আসে। নবীগণের দাওয়াতে স্ব স্ব যুগের ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হ’লেও দুনিয়া চিরদিন নবীগণকেই সম্মান করেছে, ঐসব দুষ্টমতি ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের"নয়।
তৃতীয়তঃ মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তখন তার দুনিয়াবী জীবনে যেমন কল্যাণ প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি তার পরকালীন জীবন সুখময় হয় এবং সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। হূদ (আঃ) স্বীয় জাতিকে বিশেষভাবে বলেছিলেন,"‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তাহ’লে তিনি আসমান থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন’ (হূদ ১১/৫২)। এখানে ‘শক্তি’ বলতে দৈহিক বল, জনবল ও ধনবল সবই বুঝানো"হয়েছে। তওবা ও ইস্তেগফারের ফলে এসবই লাভ করা সম্ভব, এটাই অত্র আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :
হযরত হূদ (আঃ) স্বীয় কওমে ‘আদকে শিরক পরিত্যাগ করে সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং যুলুম ও অত্যাচার পরিহার করে ন্যায় ও সুবিচারের পথে চলার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী"শক্তির অহংকারে মদমত্ত হয়ে তারা নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলল, তোমার ঘোষিত আযাব কিংবা তোমার কোন মু‘জেযা না দেখে কেবল তোমার মুখের কথায় আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্য দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না। বরং আমরা সন্দেহ করছি"যে, আমাদের দেবতাদের নিন্দাবাদ করার কারণে তাদের অভিশাপে তোমাকে ভূতে ধরেছে ও মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে তুমি উন্মাদের মত কথাবার্তা বলছ। তাদের এসব কথার উত্তরে হযরত হূদ (আঃ) পয়গম্বর সূলভ নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দেন যে, তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তবে তোমরা সাক্ষী"থাক যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমাদের ঐসব অলীক উপাস্যদের আমি মানি না। তোমরা ও তোমাদের দেবতারা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা কর। তাতে আমার কিছুই হবে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তিনিই আমার পালনকর্তা। তাঁর উপরেই আমি ভরসা রাখি। যারা সরল পথে চলে, আল্লাহ"তাদের সাহায্য করেন।
অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত জাতির বিরুদ্ধে একাকী এমন নির্ভীক ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করেনি। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাঁর একটি মু‘জেযা বিশেষ। এর দ্বারা তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, তাদের কল্পিত দেব-দেবীদের কোন ক্ষমতা নেই। অতঃপর তিনি"বললেন, আমাকে যে সত্য পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক দিয়েছেন, সে সত্য আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই থাক এবং হঠকারিতার উপরে যিদ করতে থাক, তাহ’লে জেনে রেখ এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে তোমাদের উপরে আল্লাহর সেই কঠিন"শাস্তি নেমে আসবে, যার আবেদন তোমরা আমার নিকটে বারবার করেছ। অতএব তোমরা সাবধান হও। এখনো তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এসো।
কিন্তু হতভাগার দল হযরত হূদ (আঃ)-এর কোন কথায় কর্ণপাত করল না। তারা বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে বলে উঠলো, ‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। ফলে তাদের উপরে এলাহী গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।
কওমে ‘আদ-এর উপরে আপতিত গযব-এর বিবরণ :
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বলেন, কওমে ‘আদ-এর অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গযব হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা"ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘ দেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, তোমরা কোনটি পসন্দ করো? লোকেরা কালো মেঘ কামনা করল। তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, هَذَا"عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’। জবাবে তাদের নবী হূদ (আঃ) বললেন,
‘বরং এটা সেই বস্ত্ত যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে...’।[4] ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে। সাত রাত্রি ও আট দিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘর সব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয় (ক্বামার ৫৪/২০; হাক্বক্বাহ ৬৯/৬-৮) এবং এভাবেই শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিশালবপু ‘আদ জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, এছাড়াও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী অভিসম্পাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে (হূদ ১১/৬০)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মেঘ বা ঝড় দেখতেন, তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং বলতেন হে আয়েশা! এই মেঘ ও তার মধ্যকার ঝঞ্ঝাবায়ু দিয়েই একটি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। যারা মেঘ দেখে খুশী হয়ে বলেছিল, ‘এটি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে’।[5] রাসূলের এই ভয়ের তাৎপর্য ছিল এই যে, কিছু লোকের অন্যায়ের কারণে সকলের উপর এই ব্যাপক গযব নেমে আসতে পারে। যেমন ওহোদ যুদ্ধের দিন কয়েকজনের ভুলের কারণে সকলের উপর বিপদ নেমে আসে। যেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
‘আর তোমরা ঐসব ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষভাবে কেবল তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (আনফাল ৮/২৫)।
উল্লেখ্য যে, গযব নাযিলের প্রাক্কালেই আল্লাহ স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের উক্ত এলাকা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন ও তাঁরা উক্ত আযাব থেকে রক্ষা পান (হূদ ১১/৫৮)। অতঃপর তিনি মক্কায় চলে যান ও সেখানেই ওফাত পান।[6] তবে ইবনু কাছীর হযরত আলী (রাঃ) থেকে"বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, হূদ (আঃ) ইয়ামনেই কবরস্থ হয়েছেন।[7] আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
কওমে ‘আদ-এর ধ্বংসের প্রধান কারণ সমূহ :
১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ :
(ক) তারা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহের অবমূল্যায়ন করেছিল। যার ফলে তারা আল্লাহর আনুগত্য হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং শয়তানের আনুগত্য বরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছিল (খ) আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী ভেবেছিল (গ) আল্লাহর গযব থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন"কল্পিত উপাস্যের অসীলা পূজা শুরু করেছিল (ঘ) তারা আল্লাহর নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল (ঙ) তারা আল্লাহর গযব থেকে নির্ভীক হয়ে গিয়েছিল। যদিও তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত।
২. বস্ত্তগত কারণসমূহ : প্রধানত: তিনটি :
(ক) তারা অযথা উঁচু স্থান সমূহে সুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শন সমূহ নির্মাণ করত। যা স্রেফ অপচয় ব্যতীত কিছুই ছিল না (শো‘আরা ১২৮)।
(খ) তারা অহেতুক মযবূত প্রাসাদ রাজি তৈরী করত এবং ভাবত যেন তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে (ঐ, ১২৯)।
(গ) তারা দুর্বলদের উপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানতো এবং মানুষের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো (ঐ, ১৩০)।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
উপরোক্ত বিষয়গুলির মধ্যে বর্তমান যুগের অত্যাচারী সমাজনেতা ও যালেম সরকার সমূহ এবং সভ্যতাগর্বী মানুষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ নিহিত রয়েছে। যেমন:
(১) অহি-র বিধানকে অস্বীকার করা এবং অন্যায়ের উপর যিদ ও অহংকার প্রদর্শন করাই হ’ল পৃথিবীতে আল্লাহর গযব নাযিলের প্রধান কারণ।
(২) আল্লাহ প্রেরিত গযবের ধরন বিভিন্ন রূপ হ’তে পারে। কিন্তু সেই গযবকে ঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের থাকে না।
(৩) বিলাসী, অপচয়কারী ও অত্যাচারী নেতাদের কারণেই জাতি আল্লাহর গযবের শিকার হয়ে থাকে।
(৪) আল্লাহর গযব যাদের উপর আপতিত হয়, তারা সকল যুগে নিন্দিত হয় এবং কখনোই তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
(৫) আল্লাহর বিধান লংঘনকারী ব্যক্তি বা সম্প্রদায় চূড়ান্ত বিচারে দুনিয়াতেই আল্লাহর গযবের শিকার হয়। উপরন্তু আখেরাতের আযাব তো থাকেই এবং তা হয় আরো কঠোর (ক্বলম ৬৮/৩৩)।
হূদ (আঃ)-এর পরিচয় :
হযরত হূদ (আঃ) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ‘আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ-এর পরে কওমে ‘আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। হূদ (আঃ) ছিলেন এদেরই বংশধর। ‘আদ ও ছামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্র সামের বংশধর এবং"নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত।[1] ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের"জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
‘আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হ’তে শুরু করে হাযারামাউত ও ইয়ামন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল।[2] তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদের প্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন। আল্লাহ"তা‘আলা তাদের প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্রবুদ্ধির কারণে এসব নে‘মতই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল। তারা শক্তি মদমত্ত হয়ে ‘আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে’ (ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ"১৫) বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল। তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে নূহ (আঃ)-এর আমলে ফেলে আসা মূর্তিপূজার শিরক-এর পুনরায় প্রচলন ঘটালো। মাত্র কয়েক পুরুষ আগে ঘটে যাওয়া নূহের সর্বগ্রাসী প্লাবনের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। ফলে আল্লাহ পাক তাদের"হেদায়াতের জন্য তাদেরই মধ্য হ’তে হূদ (আঃ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করলেন। উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে।
হযরত হূদ (আঃ) ও কওমে ‘আদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৭টি সূরায় ৭৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[3]
হূদ (আঃ)-এর দাওয়াত :
সূরা আ‘রাফ ৬৫-৭২ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
আর ‘আদ সম্প্রদায়ের নিকটে (আমি প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই হূদকে। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। অতঃপর তোমরা কি আল্লাহভীরু হবে না? (আ‘রাফ ৭/৬৫)। ‘তার সম্প্রদায়ের কাফের নেতারা বলল, আমরা"তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি’ (৬৬)। ‘হূদ বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই। বরং আমি বিশ্বপালকের প্রেরিত একজন রাসূল মাত্র’ (৬৭)। ‘আমি তোমাদের নিকটে প্রতিপালকের পয়গাম"সমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের হিতাকাংখী ও বিশ্বস্ত’ (৬৮)। ‘তোমরা কি আশ্চর্য বোধ করছ যে, তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে তোমাদের থেকেই একজনের নিকটে অহী (যিকর) এসেছে, যাতে সে তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে? তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে"কওমে নূহের পরে নেতৃত্বে অভিষিক্ত করলেন ও তোমাদেরকে বিশালবপু করে সৃষ্টি করলেন। অতএব তোমরা আল্লাহর নে‘মত সমূহ স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (৬৯)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে কেবল এজন্য এসেছ যে, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি, আর আমাদের বাপ-দাদারা"যাদের পূজা করত, তাদেরকে পরিত্যাগ করি? তাহ’লে নিয়ে এস আমাদের কাছে (সেই আযাব), যার দুঃসংবাদ তুমি আমাদের শুনাচ্ছ, যদি তুমি সত্যবাদী হও’ (৭০)। ‘হূদ বলল, তোমাদের উপরে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে শাস্তি ও ক্রোধ অবধারিত হয়ে গেছে। তোমরা কেন আমার সাথে"ঐসব নাম সম্পর্কে বিতর্ক করছ, যেগুলোর নামকরণ তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা করেছ? ঐসব উপাস্যদের সম্পর্কে আল্লাহ কোন প্রমাণ (সুলতান) নাযিল করেননি। অতএব অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি’ (৭১)। ‘অনন্তর আমরা তাকে ও তার সাথীদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে"রক্ষা করলাম এবং যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করেছিল, তাদের মূলোৎপাটন করে দিলাম। বস্ত্ততঃ তারা বিশ্বাসী ছিল না’ (আ‘রাফ ৭/৬৫-৭২)।
অতঃপর সূরা হূদ ৫০-৬০ আয়াতে আল্লাহ উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন নিম্নরূপেঃ
অনুবাদঃ আর ‘আদ জাতির প্রতি (আমরা) তাদের ভাই হূদকে (প্রেরণ করেছিলাম)। সে তাদেরকে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন মা‘বূদ নেই। বস্ত্ততঃ তোমরা সবাই এ ব্যাপারে মিথ্যারোপ করছ’ (হূদ ১১/৫০)। ‘হে আমার জাতি! (আমার এ দাওয়াতের"জন্য) আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না। আমার পারিতোষিক তাঁরই কাছে রয়েছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা কি বুঝ না’? (৫১)। ‘হে আমার কওম! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাও। তিনি আসমান থেকে তোমাদের"উপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন। তোমরা অপরাধীদের ন্যায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (৫২)। ‘তারা বলল, হে হূদ! তুমি আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নিয়ে আসনি, আর আমরাও তোমার কথা মত আমাদের উপাস্যদের বর্জন করতে পারি না। বস্ত্ততঃ"আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসী নই’ (৫৩)। ‘বরং আমরা তো একথাই বলতে চাই যে, আমাদের কোন উপাস্য-দেবতা (তোমার অবিশ্বাসের ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে) তোমার উপরে অশুভ আছর করেছেন। হূদ বলল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি, আর তোমরাও সাক্ষী থাক যে, তাদের থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত,"যাদেরকে তোমরা শরীক করে থাক’ (৫৪) ‘তাঁকে ছাড়া। অতঃপর তোমরা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট করার প্রয়াস চালাও এবং আমাকে কোনরূপ অবকাশ দিয়ো না’ (৫৫)। ‘আমি আল্লাহর উপরে ভরসা করেছি। যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই, যা তাঁর"আয়ত্তাধীন নয়। আমার পালনকর্তা সরল পথে আছেন’ (অর্থাৎ সরল পথের পথিকগণের সাথে আছেন)’ (৫৬)। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে (জেনে রেখ যে,) আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি যা নিয়ে আমি তোমাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছি। আমার প্রভু অন্য কোন জাতিকে তোমাদের"স্থলাভিষিক্ত করবেন, তখন তোমরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা প্রতিটি বস্ত্তর হেফাযতকারী’ (৫৭)। ‘অতঃপর যখন আমাদের আদেশ (গযব) উপস্থিত হ’ল, তখন আমরা নিজ অনুগ্রহে হূদ ও তার সাথী ঈমানদারগণকে মুক্ত করি এবং তাদেরকে এক কঠিন আযাব"থেকে রক্ষা করি’ (৫৮)। ‘এরা ছিল ‘আদ জাতি। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহকে (নিদর্শন সমূহকে) অস্বীকার করেছিল ও তাদের নিকটে প্রেরিত রাসূলগণের অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা উদ্ধত ও হঠকারী ব্যক্তিদের আদেশ পালন করেছিল’ (৫৯)। ‘এ দুনিয়ায় তাদের পিছে পিছে অভিসম্পাৎ"রয়েছে এবং রয়েছে ক্বিয়ামতের দিনেও। জেনে রেখ ‘আদ জাতি তাদের পালনকর্তার সাথে কুফরী করেছে। জেনে রেখ হূদের কওম ‘আদ জাতির জন্য অভিসম্পাৎ’ (হূদ ১১/৫০-৬০)।
হূদ (আঃ) তাঁর জাতিকে তাদের বিলাসোপকরণ ও অন্যায় আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং এতদসত্ত্বেও তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ সমূহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যেমন সূরা শো‘আরায় ১২৮-১৩৯ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,
অনুবাদঃ ‘তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে অযথা নিদর্শন নির্মাণ করছ (২৬/১২৮)? (যেমন সুউচ্চ টাওয়ার, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি)। ‘এবং তোমরা বড় বড় প্রাসাদ সমূহ নির্মাণ করছ, যেন তোমরা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে’ (১২৯)? (যেমন ধনী ব্যক্তিরা দেশে ও বিদেশে"বিনা প্রয়োজনে বড় বড় বাড়ী করে থাকে)। ‘এছাড়া যখন তোমরা কাউকে আঘাত হানো, তখন নিষ্ঠুর-যালেমদের মত আঘাত হেনে থাক (১৩০)’ (বিভিন্ন দেশে পুলিশী নির্যাতনের বিষয়টি স্মরণযোগ্য)। ‘অতএব তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর (১৩১)’। ‘তোমরা ভয় কর সেই মহান"সত্তাকে, যিনি তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন ঐসব বস্ত্ত দ্বারা যা তোমরা জানো’ (১৩২)। ‘তিনি তোমাদের সাহায্য করেছেন গবাদি পশু ও সন্তানাদি দ্বারা (১৩৩)’ ‘এবং উদ্যান ও ঝরণা সমূহ দ্বারা (১৩৪)’। (অতঃপর হূদ (আঃ) কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়ে বললেন,) ‘আমি তোমাদের জন্য"মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করছি’ (১৩৫)। জবাবে কওমের নেতারা বলল, ‘তুমি উপদেশ দাও বা না দাও সবই আমাদের জন্য সমান’ (১৩৬)। ‘তোমার এসব কথাবার্তা পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-অভ্যাস বৈ কিছু নয়’ (১৩৭)। ‘আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হব না’ (১৩৮)। (আল্লাহ বলেন,) ‘অতঃপর (এভাবে)"তারা তাদের নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। ফলে আমিও তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। এর মধ্যে (শিক্ষণীয়) নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (শো‘আরা ২৬/১২৮-১৩৯)।
সূরা হা-মীম সাজদার ১৪-১৬ আয়াতে ‘আদ জাতির অলীক দাবী, অযথা দম্ভ ও তাদের উপরে আপতিত শাস্তির বর্ণনা সমূহ এসেছে এভাবে,
‘...তারা (‘আদ ও ছামূদের লোকেরা) বলেছিল, আমাদের প্রভু ইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা পাঠাতেন। অতএব আমরা তোমাদের আনীত বিষয় অমান্য করলাম’ (৪১/১৪)। ‘অতঃপর ‘আদ-এর লোকেরা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করল এবং বলল, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিধর কে আছে? তারা কি লক্ষ্য করেনি"যে, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্ত্ততঃ তারা আমাদের নিদর্শন সমূহ অস্বীকার করত’ (১৫)। ‘অতঃপর আমরা তাদের উপরে প্রেরণ করলাম ঝঞ্ঝাবায়ু বেশ কয়েকটি অশুভ দিনে, যাতে তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনার কিছু আযাব আস্বাদন"করানো যায়। আর পরকালের আযাব তো আরও লাঞ্ছনাকর। যেদিন তারা কোনরূপ সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৪-১৬)।
সূরা আহক্বাফ ২১-২৬ আয়াতে উক্ত আযাবের ধরন বর্ণিত হয়েছে এভাবে, যেমন আল্লাহ বলেন,
‘আর তুমি ‘আদ-এর ভাই (হূদ)-এর কথা বর্ণনা কর, যখন সে তার কওমকে বালুকাময় উঁচু উপত্যকায় সতর্ক করে বলেছিল, অথচ তার পূর্বে ও পরে অনেক সতর্ককারী গত হয়েছিল, (এই মর্মে যে,) তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ইবাদত কর না। আমি তোমাদের জন্য এক মহাদিবসের শাস্তির"আশংকা করছি’ (আহক্বাফ ৪৬/২১)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্য সমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখতে আগমন করেছ? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তবে আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি?’ (২২)। হূদ বলল, এ জ্ঞান তো স্রেফ আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি"যে বিষয় নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি দেখছি তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়’ (২৩)। অতঃপর তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা সমূহের অভিমুখী দেখল, তখন বলল, এতো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। (হূদ বললেন) বরং এটা সেই বস্ত্ত,"যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু, যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’ (২৪)। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবকিছুকে ধ্বংস করে দেবে। অতঃপর ভোর বেলায় তারা এমন অবস্থা প্রাপ্ত হ’ল যে, শূন্য বাস্ত্তভিটাগুলি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হ’ল না। আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে"এমনি করেই শাস্তি দিয়ে থাকি’ (২৫)। ‘আমি তাদেরকে এমন সব বিষয়ে ক্ষমতা দিয়েছিলাম, যেসব বিষয়ে তোমাদের ক্ষমতা দেইনি। আমি তাদের দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়। কিন্তু সেসব কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় তাদের কোন কাজে আসল না, যখন তারা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার"করল এবং সেই শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করল, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত’ (আহক্বাফ ৪৬/২১-২৬)।
উক্ত বিষয়ে সূরা হা-ক্বক্বাহ ৭-৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘তাদের উপরে প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু প্রবাহিত হয়েছিল সাত রাত্রি ও আট দিবস ব্যাপী অবিরতভাবে। (হে মুহাম্মাদ!) তুমি দেখলে দেখতে পেতে যে, তারা অসার খর্জুর কান্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে রয়েছে’ (৭)। ‘তুমি (এখন) তাদের কোন অস্তিত্ব দেখতে পাও কি’? (হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৭-৮)।
সূরা ফাজ্র ৬-৮ আয়াতে ‘আদ বংশের শৌর্য-বীর্য সম্বন্ধে আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে শুনিয়ে বলেন,
‘আপনি কি জানেন না আপনার প্রভু কিরূপ আচরণ করেছিলেন ‘আদে ইরম (প্রথম ‘আদ) গোত্রের সাথে’? (ফজর ৬) ‘যারা ছিল উঁচু স্তম্ভসমূহের মালিক (৭)। ‘এবং যাদের সমান কাউকে জনপদ সমূহে সৃষ্টি করা হয়নি’ (ফাজ্র ৮৯/৬-৮)।
কওমে ‘আদ-এর প্রতি হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম :
কওমে নূহের প্রতি হযরত নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম এবং কওমে ‘আদ-এর প্রতি হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম প্রায় একই। হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারকথাগুলি সূরা হূদ-এর ৫০, ৫১ ও ৫২ আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, যা এক কথায় বলা যায়- তাওহীদ, তাবলীগ ও ইস্তেগফার।"প্রথমে তিনি নিজ কওমকে তাদের কল্পিত উপাস্যদের ছেড়ে একক উপাস্য আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি ইবাদতের আহবান জানান, যাকে বলা হয় ‘তাওহীদে ইবাদত’। অতঃপর তিনি জনজীবনকে শিরকের আবিলতা ও নানাবিধ কুসংস্কারের পংকিলতা হ’তে মুক্ত করার জন্য"নিঃস্বার্থভাবে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাদের নিকট আল্লাহর বিধানসমূহ পৌঁছে দিতে থাকেন। তাঁর এই দাওয়াত ও তাবলীগ ছিল নিরন্তর ও অবিরত ধারায় এবং যাবতীয় বস্ত্তগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অতঃপর তিনি জনগণকে নিজেদের কুফরী, শেরেকী ও অন্যান্য কবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে"তওবা করার ও আল্লাহর নিকটে একান্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানান।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে সকল নবীই দাওয়াত দিয়েছেন। মূলতঃ উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি। মানুষ যখনই নিজেদের কল্পিত দেব-দেবী ও মূর্তি-প্রতিমাসহ বিভিন্ন উপাস্যের নিকটে মাথা নত করবে ও তাদেরকেই মুক্তির অসীলা"কিংবা সরাসরি মুক্তিদাতা ভাববে, তখনই তার শ্রেষ্ঠত্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। নিকৃষ্ট সৃষ্টি সাপ ও তুলসী গাছ পর্যন্ত তার পূজা পাবে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও তার সেবা বাদ দিয়ে সে নির্জীব মূর্তির সেবায় লিপ্ত হবে। একজন ক্ষুধার্ত ভাইকে বা একটি অসহায় প্রাণীকে"খাদ্য না দিয়ে সে নিজেদের হাতে গড়া অক্ষম-অনড় মূর্তিকে দুধ-কলার নৈবেদ্য পেশ করবে ও পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করবে। এমনকি কল্পিত দেবতাকে খুশী করার জন্য সে নরবলি বা সতীদাহ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। পক্ষান্তরে যখনই একজন মানুষ সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ্কে"তার সৃষ্টিকর্তা, রূযীদাতা, বিপদহন্তা, বিধানদাতা, জীবন ও মরণদাতা হিসাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, তখনই সে অন্য সকল সৃষ্টির প্রতি মিথ্যা আনুগত্য হ’তে মুক্তি পাবে। আল্লাহর গোলামীর অধীনে নিজেকে স্বাধীন ও সৃষ্টির সেরা হিসাবে ভাবতে শুরু করবে। তার সেবার"জন্য সৃষ্ট জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষের সবকিছুর উপরে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সে উদ্বুদ্ধ হবে। তার জ্ঞান ও উপলব্ধি যত বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টজীবের প্রতি তার দায়িত্ববোধ তত উচ্চকিত হবে।
দ্বিতীয়তঃ বস্ত্তগত কোন স্বার্থ ছাড়াই মানুষ যখন কাউকে সৎ পথের দাওয়াত দেয়, তখন তা অন্যের মনে প্রভাব বিস্তার করে। ঐ দাওয়াত যদি তার হৃদয় উৎসারিত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের পথের দাওয়াত হয়, তাহ’লে তা অন্যের হৃদয়ে রেখাপাত করে। সংশোধন"মূলক দাওয়াত প্রথমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা অবশেষে কল্যাণময় ফলাফল নিয়ে আসে। নবীগণের দাওয়াতে স্ব স্ব যুগের ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হ’লেও দুনিয়া চিরদিন নবীগণকেই সম্মান করেছে, ঐসব দুষ্টমতি ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের"নয়।
তৃতীয়তঃ মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তখন তার দুনিয়াবী জীবনে যেমন কল্যাণ প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি তার পরকালীন জীবন সুখময় হয় এবং সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। হূদ (আঃ) স্বীয় জাতিকে বিশেষভাবে বলেছিলেন,"‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তাহ’লে তিনি আসমান থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন’ (হূদ ১১/৫২)। এখানে ‘শক্তি’ বলতে দৈহিক বল, জনবল ও ধনবল সবই বুঝানো"হয়েছে। তওবা ও ইস্তেগফারের ফলে এসবই লাভ করা সম্ভব, এটাই অত্র আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :
হযরত হূদ (আঃ) স্বীয় কওমে ‘আদকে শিরক পরিত্যাগ করে সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং যুলুম ও অত্যাচার পরিহার করে ন্যায় ও সুবিচারের পথে চলার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী"শক্তির অহংকারে মদমত্ত হয়ে তারা নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলল, তোমার ঘোষিত আযাব কিংবা তোমার কোন মু‘জেযা না দেখে কেবল তোমার মুখের কথায় আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্য দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না। বরং আমরা সন্দেহ করছি"যে, আমাদের দেবতাদের নিন্দাবাদ করার কারণে তাদের অভিশাপে তোমাকে ভূতে ধরেছে ও মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে তুমি উন্মাদের মত কথাবার্তা বলছ। তাদের এসব কথার উত্তরে হযরত হূদ (আঃ) পয়গম্বর সূলভ নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দেন যে, তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তবে তোমরা সাক্ষী"থাক যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমাদের ঐসব অলীক উপাস্যদের আমি মানি না। তোমরা ও তোমাদের দেবতারা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা কর। তাতে আমার কিছুই হবে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তিনিই আমার পালনকর্তা। তাঁর উপরেই আমি ভরসা রাখি। যারা সরল পথে চলে, আল্লাহ"তাদের সাহায্য করেন।
অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত জাতির বিরুদ্ধে একাকী এমন নির্ভীক ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করেনি। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাঁর একটি মু‘জেযা বিশেষ। এর দ্বারা তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, তাদের কল্পিত দেব-দেবীদের কোন ক্ষমতা নেই। অতঃপর তিনি"বললেন, আমাকে যে সত্য পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক দিয়েছেন, সে সত্য আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই থাক এবং হঠকারিতার উপরে যিদ করতে থাক, তাহ’লে জেনে রেখ এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে তোমাদের উপরে আল্লাহর সেই কঠিন"শাস্তি নেমে আসবে, যার আবেদন তোমরা আমার নিকটে বারবার করেছ। অতএব তোমরা সাবধান হও। এখনো তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এসো।
কিন্তু হতভাগার দল হযরত হূদ (আঃ)-এর কোন কথায় কর্ণপাত করল না। তারা বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে বলে উঠলো, ‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। ফলে তাদের উপরে এলাহী গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।
কওমে ‘আদ-এর উপরে আপতিত গযব-এর বিবরণ :
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বলেন, কওমে ‘আদ-এর অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গযব হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা"ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘ দেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, তোমরা কোনটি পসন্দ করো? লোকেরা কালো মেঘ কামনা করল। তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, هَذَا"عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’। জবাবে তাদের নবী হূদ (আঃ) বললেন,
‘বরং এটা সেই বস্ত্ত যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে...’।[4] ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে। সাত রাত্রি ও আট দিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘর সব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয় (ক্বামার ৫৪/২০; হাক্বক্বাহ ৬৯/৬-৮) এবং এভাবেই শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিশালবপু ‘আদ জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, এছাড়াও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী অভিসম্পাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে (হূদ ১১/৬০)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মেঘ বা ঝড় দেখতেন, তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং বলতেন হে আয়েশা! এই মেঘ ও তার মধ্যকার ঝঞ্ঝাবায়ু দিয়েই একটি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। যারা মেঘ দেখে খুশী হয়ে বলেছিল, ‘এটি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে’।[5] রাসূলের এই ভয়ের তাৎপর্য ছিল এই যে, কিছু লোকের অন্যায়ের কারণে সকলের উপর এই ব্যাপক গযব নেমে আসতে পারে। যেমন ওহোদ যুদ্ধের দিন কয়েকজনের ভুলের কারণে সকলের উপর বিপদ নেমে আসে। যেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
‘আর তোমরা ঐসব ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষভাবে কেবল তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (আনফাল ৮/২৫)।
উল্লেখ্য যে, গযব নাযিলের প্রাক্কালেই আল্লাহ স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের উক্ত এলাকা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন ও তাঁরা উক্ত আযাব থেকে রক্ষা পান (হূদ ১১/৫৮)। অতঃপর তিনি মক্কায় চলে যান ও সেখানেই ওফাত পান।[6] তবে ইবনু কাছীর হযরত আলী (রাঃ) থেকে"বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, হূদ (আঃ) ইয়ামনেই কবরস্থ হয়েছেন।[7] আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
কওমে ‘আদ-এর ধ্বংসের প্রধান কারণ সমূহ :
১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ :
(ক) তারা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহের অবমূল্যায়ন করেছিল। যার ফলে তারা আল্লাহর আনুগত্য হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং শয়তানের আনুগত্য বরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছিল (খ) আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী ভেবেছিল (গ) আল্লাহর গযব থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন"কল্পিত উপাস্যের অসীলা পূজা শুরু করেছিল (ঘ) তারা আল্লাহর নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল (ঙ) তারা আল্লাহর গযব থেকে নির্ভীক হয়ে গিয়েছিল। যদিও তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত।
২. বস্ত্তগত কারণসমূহ : প্রধানত: তিনটি :
(ক) তারা অযথা উঁচু স্থান সমূহে সুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শন সমূহ নির্মাণ করত। যা স্রেফ অপচয় ব্যতীত কিছুই ছিল না (শো‘আরা ১২৮)।
(খ) তারা অহেতুক মযবূত প্রাসাদ রাজি তৈরী করত এবং ভাবত যেন তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে (ঐ, ১২৯)।
(গ) তারা দুর্বলদের উপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানতো এবং মানুষের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো (ঐ, ১৩০)।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
উপরোক্ত বিষয়গুলির মধ্যে বর্তমান যুগের অত্যাচারী সমাজনেতা ও যালেম সরকার সমূহ এবং সভ্যতাগর্বী মানুষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ নিহিত রয়েছে। যেমন:
(১) অহি-র বিধানকে অস্বীকার করা এবং অন্যায়ের উপর যিদ ও অহংকার প্রদর্শন করাই হ’ল পৃথিবীতে আল্লাহর গযব নাযিলের প্রধান কারণ।
(২) আল্লাহ প্রেরিত গযবের ধরন বিভিন্ন রূপ হ’তে পারে। কিন্তু সেই গযবকে ঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের থাকে না।
(৩) বিলাসী, অপচয়কারী ও অত্যাচারী নেতাদের কারণেই জাতি আল্লাহর গযবের শিকার হয়ে থাকে।
(৪) আল্লাহর গযব যাদের উপর আপতিত হয়, তারা সকল যুগে নিন্দিত হয় এবং কখনোই তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
(৫) আল্লাহর বিধান লংঘনকারী ব্যক্তি বা সম্প্রদায় চূড়ান্ত বিচারে দুনিয়াতেই আল্লাহর গযবের শিকার হয়। উপরন্তু আখেরাতের আযাব তো থাকেই এবং তা হয় আরো কঠোর (ক্বলম ৬৮/৩৩)।
Comments
Post a Comment